দুষ্টচক্র

‘কতদিনের প্র্যাকটিস আপনার?’

‘এখানে বছর তিনেক আছি‌, তার আগে মফঃস্বলে ছিলাম।’

‘ভালই চলছে মনে হয়–কেমন?’

‘মন্দ নয়–চলছে টুকটাক করে। দু-চারটে বাঁধা ঘর আছে। সম্প্রতি পসার কিছু বেড়েছে। বিশুবাবুকে যদি সারিয়ে তুলতে পারি–’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল‌, ‘হ্যাঁ। — আচ্ছা ডাক্তারবাবু্‌, বিশু পালের এই যে মৃত্যুভয়‌, এটা কি ওঁর মনের রোগ? না সত্যিই ভয়ের কারণ আছে?’

ডাক্তার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন‌, ‘ভয়ের কারণ আছে। অবশ্য যাদের অনেক টাকা তাদের মৃত্যুভয় বেশি হয়। কিন্তু বিশু পালের ভয় অমূলক নয়। অভয় ঘোষাল লোকটা সত্যিকার খুনী। আমি শুনেছি ও গোটা তিনেক খুন করেছে। এমন কি ও নিজের বোপকে বিষ খাইয়েছিল। কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই নাকি! ভারি গুণধর ছেলে তো। এখন মনে পড়ছে বছর দুই আগে ওর মামলার বয়ান খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। ওর ঠিকানা আপনি জানেন নাকি?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘জানি। এই তো কাছেই‌, বড়জোর মাইলখানেক। যদি দেখা করতে চান ঠিকানা দিচ্ছি।’

এক টুকরা কাগজে ঠিকানা লিখিয়া ডাক্তার ব্যোমকেশকে দিলেন‌, সে সেটি মুড়িয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল‌, ‘আর একটা কথা। বিশুবাবুর স্ত্রীর কি কোনো রোগ আছে?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘স্নায়ুর রোগ। স্নায়ুবিক প্রকৃতির মহিলা‌, তার ওপর ছেলেপুলে হয়নি–’

‘বুঝেছি। — আচ্ছা‌, চললাম। বিশুবাবু একশো টাকা দিয়ে আমাকে দায়ে ফেলেছেন। তাঁর সমস্যাটা ভেবে দেখব।’

বাহিরে তখন‌, রাস্তার আলো জ্বলিয়াছে। ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল‌, ‘সাড়ে ছটা। চল‌, খুনি আসামী দর্শন করে যাওয়া যাক। বিশু পাল যখন টাকা দিয়েছেন‌, তখন কিছু তো করা দরকার।’

মোড়ের মাথায় একটা রিকশা পাওয়া গেল‌, তাহাতে চড়িয়া আমরা উত্তর দিকে চলিলাম। লক্ষ্য করিয়াছি‌, আমহার্স্ট স্ত্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আশেপাশে সামনে পিছনে যখন জোয়ারের সমুদ্রের মত জনস্রোত ছুটিয়াছে‌, তখনও আমহার্স্ট স্ট্রীটে লোক চলাচল অপেক্ষাকৃত কম; আমহার্স্ট স্ট্রীট সমুদ্রের সমান্তরাল সঙ্কীর্ণ খালের মত নিস্তরঙ্গ পড়িয়া আছে।

রাস্তায় উত্তর প্রাস্তে আসিয়া একটি নম্বরের সামনে রিকশা থামিল‌, আমরা নামিলাম। ব্যোমকেশ নম্বর মিলাইয়া বলিল‌, ‘এই বাড়ি।’

বাড়িটি ঠিক ফুটপাথের ধারে নয়‌, মাঝখানে একটু খোলা জমি আছে‌, তাহাতে কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় বাড়িটিকে রাস্ত হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতল বাড়ির উপরতলা অন্ধকার‌, নীচের একটা জানোলা দিয়া পত্রান্তরাল ভেদ করিয়া ঝিকিমিকি আলো আসিতেছে।

আমরা ছেট ফটক দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

সামনের ঘর টেবিল চেয়ার দিয়া সাজানো‌, যেন অফিস ঘর। একটি লোক চেয়ারে বসিয়া অলসভাবে পেন্সিল দিয়া কাগজের উপর হিজিবিজি কাটিতেছে। আমরা দ্বারের কাছে আসিলে সে চোখ তুলিয়া চাহিল।

সুপুরুষ বটে। বয়স আন্দাজ পয়ত্রিশ‌, টকটকে রঙ‌, কোঁকড়া চুলের মাঝখানে সিঁথি‌, নাক চোখ যেন তুলি দিয়া আঁকা। আমিও বিশু পালের মত মুগ্ধ হইয়া গেলাম।

ব্যোমকেশ দ্বারের নিকট হইতে বলিল‌, ‘আসতে পারি? আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী‌, ইনি অজিত বন্দ্যো।’

অভয় ঘোষালের চোখের দৃষ্টি সতর্ক। তারপর সে অধর প্রান্তে একটি মুকুলিত হাসি ফুটাইয়া বলিল‌, ‘সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! কী সৌভাগ্য। আসুন।’

আমরা গিয়া অভয় ঘোষালের মুখোমুখি বসিলাম। সে পেন্সিল নামাইয়া রাখিয়া বলিল‌, ‘কি ব্যাপার বলুন দেখি। সম্প্রতি কোনো কু-কাৰ্য করেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

ব্যোমকেশ হাসিল‌, ‘আপনাকে দেখতে এলাম।’

অভয় ঘোষাল বলিল‌, ‘ধন্যবাদ! আমি তাহলে একটি দর্শনীয় জীব। আপনি নিজের ইচ্ছেয় এসেছেন‌, না কেউ পাঠিয়েছে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পাঠায়নি কেউ। কিন্তু মহাজন বিশু পাল তাঁর দুঃখের কথা আমাকে শোনালেন‌, তাই ভাবলাম আপনাকে দর্শন করে যাই।’

‘ও–শিশুপাল।’ অভয় ঘোষাল ক্ষণেক থামিয়া বলিল‌, ‘আপনাকে কেউ পাঠিয়েছে। বুঝেছিলাম‌, কিন্তু শিশুপালের কথা মনে আসেনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘জানেন বোধ হয়‌, বিশু পালের পক্ষাঘাত হয়েছে।’

অভয় বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল‌, ‘তাই নাকি; আমি জানতাম না। মাস তিনেক আগে শিশুপাল আমার বাড়িতে এসেছিল‌, আমাকে চৌদ-পুরুষান্ত করে গেল। ভগবান আছেন।’ তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনো উষ্মা প্রকাশ পাইল না। পেন্সিলটা তুলিয়া লইয়া সে আবার কাগজে হিজিবিজি কাটিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখান থেকে ফিরে গিয়েই তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল। সেই থেকে তিনি নিজের বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছেন। অবশ্য পক্ষাঘাতাই তাঁর বাড়িতে আবদ্ধ থাকার একমাত্র কারণ নয়। আপনার ভয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হন না।’

‘আমার ভয়ে–বলেন কি! আমি খাতক‌, সে মহাজন‌, আমারই তার ভয়ে লুকিয়ে থাকার কথা।’ অভয় ঘোষাল ভ্রূ তুলিয়া পরম বিস্ময়ভরে কথাগুলি বলিল‌, কিন্তু তাহার অধর-প্রান্তে হাসি লাগিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাঁর ভয় হয়েছে আপনি তাঁকে খুন করবেন।’

‘এই দেখুন। যত দোষ নন্দ ঘোষ! আমি একটিবার খুনের মামলায় ফেঁসে গিয়েছিলাম‌, অমনি সবাই ভেবে নিলে আমি খুনী আসামী–আমি যে বেকসুর খালাস পেয়েছি সেটা কেউ ভাবল না।’ অভয় ঘোষাল একটু থামিয়া অপেক্ষাকৃত মন্থর কণ্ঠে বলিল‌, ‘তবে একটা কথা সত্যি। আমার কোষ্ঠীর ফল–যারা আমার শক্রতা করে তারা বেশি দিন বাঁচে না।–উঠছেন নাকি?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ। আপনাকে দেখতে এসেছিলাম‌, দেখা হয়েছে। এবার যাওয়া যাক। —একটা কথা বলে যাই। বিশু পালের যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় আমি খুব দুঃখিত হব। এবং আপনিও শেষ পর্যন্ত দুঃখিত হবেন।’

0 Shares