দুষ্টচক্র

অভয় ঘোষালের মুখে হঠাৎ পরিবর্তন হইল। মুখের হাসি মুছিয়া গিয়া চোখে একটা নৃশংস হিংস্বতা ফুটিয়া উঠিল। সে নির্নিমেষ সৰ্প-চক্ষু মেলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল।

আমার বুকের একটা স্পন্দন থামিয়া গিয়া আবার সবেগে চলিতে আরম্ভ করিল। এই দৃষ্টি বিশু পালকে ভয়ে দিশাহারা করিয়াছিল। চোখের দৃষ্টিতে মৃত্যুর শপথ এত স্পষ্টভাবে আর কাহারো চোখে দেখি নাই।

ব্যোমকেশ তাহার প্রতি একটি অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল‌, ‘চল অজিত।’

ফুটপাথে পৌঁছিয়া দেখিলাম, রাস্তায় পরপারে একটা ট্যাক্সি দাঁড়াইয়া আছে। ড্রাইভারকে ডাকিবার জন্য হাত তুলিয়াছি, ট্যাক্সিটা চলিতে আরম্ভ করিল, দ্রুত বেগ সংগ্ৰহ করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

আমি ব্যোমকেশের পানে চাহিলাম। সে বিলীয়মান ট্যাক্সির দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘ভেতরে কেউ ছিল?’

বলিলাম, ‘দেখিনি। ড্রাইভারটা কিন্তু আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল, তাই ভেবেছিলাম খালি ট্যাক্সি। হয়তো পিছনের সিটো কেউ ছিল ৷ ‘

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ চলিতে আরম্ভ করিল, ‘কেউ বোধ হয় আমাদের পিছু নিয়েছিল।’

‘কে পিছু নিতে পারে?’

‘ডাক্তার রক্ষিত ছাড়া আর তো কেউ জানে না যে আমরা এখানে এসেছি।’

‘কিন্তু কেন? কী উদ্দেশ্য?’

‘তা জানি না। অবশ্য সমাপতনও হতে পারে। ট্যাক্সিতে আমাদের অজানা আরোহী ছিল, কোনো কারণে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল, তারপর চলে গেল।’

রাত্রি সাড়ে সাতটা। আমরা পদব্ৰজে বাসার দিকে চলিলাম। মনে কিন্তু একটা ধোঁকা লাগিয়া রহিল।

পরদিন সকালে খবরের কাগজ খুলিয়াই বলিয়া উঠিলাম, ‘ওহে—!’

ব্যোমকেশ চকিতে আমার দিকে ঘাড় ফিরাইল, ‘কী ! বিশু পাল খুন হয়েছে?’

বলিলাম, ‘বিশু পাল নয়–অভয় ঘোষাল।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বোকার মত আমার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর কাগজখানা আমার হাত হইতে কড়িয়া লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।

সংবাদপত্রের বিবরণ অতি সংক্ষিপ্ত। গত রাত্রে আমহাস্ট স্ট্রীট নিবাসী অভয় ঘোষাল নামক এক ধনী ব্যক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় শয্যায় খুন হইয়াছেন। পুলিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছে; কে খুন করিয়াছে তাহা এখনো জানা যায় নাই। দুই বৎসর পূর্বে অভয় ঘোষাল খুনের অভিযোগে আসামী হইয়া বেকসুর খালাস হইয়াছিলেন। —

মনটা অন্য প্রকার সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত ছিল, তাই অনেকক্ষণ বিমূঢ় রহিলাম। কাল রাত্রি সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমরা তাহাকে দেখিয়াছি, সে হাসিমুখে পরম স্বচ্ছন্দভাবে ব্যোমকেশের সহিত প্রচ্ছন্ন বাকযুদ্ধ করিয়াছে। তারপর কী হইল? সে ব্যঙ্গভরে বলিয়াছিল, তাহার অনেক ‘বন্ধু আছে। ট্যাক্সিতে তবে কি তাহার ‘বন্ধু ওৎ পাতিয়া বসিয়া ছিল, আমরা চলিয়া যাইবার পর ফিরিয়া আসিয়া তাহাকে খুন করিয়াছে? কিম্বা ট্যাক্সির লোকটি ডাক্তার রক্ষিত? কিন্তু ডাক্তার রক্ষিত তাহাকে খুন করিতে যাইবে কেন?

বেশি জল্পনা-কল্পনা করিবার আগেই দারোগা রমাপতিবাবু উপস্থিত হইলেন।

রমাপতিবাবুর সহিত কর্ম সম্পর্কে আমাদের ঘনিষ্ঠতা না থাকিলেও অল্প পরিচয় ছিল। কাজের লোক বলিয়া পুলিস বিভাগে তাঁহার সুনাম আছে। আমাদেরই সমবয়স্ক ব্যক্তি; মজবুত চেহারা, অমায়িক বাচনভঙ্গী, চোখের দৃষ্টি মৰ্মভেদী।

ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া তাঁহাকে বসাইল, বলিল, ‘কাগজে দেখলাম। আপনার এলাকায় অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে। ‘

রমাপতিবাবু চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ‘আপনি অভয় ঘোষালকে চিনতেন?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘চিনতাম না, কাল সন্ধ্যেবেলা পরিচয় হয়েছিল। আমরা তার বাড়িতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে দেখা করতে?’

‘তাই নাকি ! দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন?’ ব্যোমকেশ সহাস্যে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘আগে আপনি খবর বলুন, তারপর আমি বলব।’

রমাপতিবাবু ক্ষণেক ইতস্তত করিয়া বলিলেন‌, ‘আচ্ছা‌, আমিই আগে বলছি। অভয় ঘোষালের ওপর অনেক দিন থেকে পুলিসের নজর ছিল। লোকটা ভদ্রতার মুখোশ পরে বেড়াতো‌, কিন্তু এত বড় শয়তান খুব কম দেখা যায়। কত ভদ্রঘরের মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। নিজের একটা স্ত্রী ছিল‌, হঠাৎ তার অপঘাত মৃত্যু হয়। তারপর এক ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হয়েছিল; ভদ্রলোক স্ত্রীকে ডিভোর্স করেন। তখন স্ত্রীলোকটি বোধ হয়। অভয়কে বিয়ে করার জন্যে বায়না ধরেছিল, অভয় তাকে বিষ খাইয়ে মারে।

‘অভয় ঘোষালকে পুলিস অ্যারেস্ট করল‌, মামলা কোর্টে উঠল। কিন্তু মামলা টিকল না‌, অভয়ের অপরাধ পাকাপাকি প্রমাণ হল না। ৩০২ ধারার মামলা‌, হয় এসপার নয় ওসপার‌, অভয় ঘোষাল ছাড়া পেয়ে গেল।

‘এই হল অভয় ঘোষালের ইতিহাস। কলকাতা শহরেই অন্তত দশজন লোক আছে যারা তাকে খুন করতে পারলে খুশি হয়।

‘কাল রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময় অভয়ের বাড়ির চাকরানী থানায় এসে খবর দেয় যে অভয় খুন হয়েছে। আমি তখন থানায় ছিলাম না‌, খবর পেয়ে তদন্ত করতে গেলাম। অভয় ঘোষালের আর্থিক অবস্থা এখন পড়ে গেছে; বাড়িতে একলা থাকে‌, কেবল একটা কম-বয়সী চাকরানী দেখাশোনা করে। এই চাকরানীটাই থানায় খবর দিতে এসেছিল।

‘গিয়ে দেখলাম অভয় দোতলার ঘরে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে‌, তার পিঠের বাঁ দিকে গুনাহঁচের মত একটা শলা বিধে আছে। চাকরানীকে সওয়াল করে জানা গেল যে অভয় রাত্রি ন’টার সময় খাওয়া-দাওয়া করে শুতে গিয়েছিল; চাকরানী বাড়ির কাজকর্ম সেরে‌, নিজে খেয়ে‌, দোর জানলা বন্ধ করে অভয়ের ঘরে গিয়ে দেখল ইতিমধ্যে কেউ এসে অভয়কে খুন করে রেখে গেছে।

0 Shares