‘আমরা চাকরানীটাকে আটক করে রেখেছি, কিন্তু সে বোধ হয় খুন করেনি। কে খুন করেছে। তাও জানা যাচ্ছে না। অভয়ের সঙ্গে যাদের শক্রতা ছিল–মামলায় যারা অভয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল— তাদের সকলের অ্যালিবাই যাচাই করে দেখেছি, তারা কেউ নয় বলেই মনে হয়।
‘এই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি! এখন আপনি কি জানেন বলুন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি যে কিছু জানি তা আপনি জানলেন কি করে?’
রামপতিবাবু পকেট হইতে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া ব্যোমকেশের দিকে বাড়াইয়া দিলেন, ‘এই কাগজের টুকরোটা নীচের তলায় অভয়ের বসবার ঘরে টেবিলের ওপর রাখা ছিল।’
গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, কাগজের উপর পেন্সিল দিয়া হিজিবিজি কাটা, তারপর লেখা আছে–ব্যোমকেশ বক্সী–শিশুপাল–। মনে পড়িয়া গেল কাল রাত্ৰে অভয় ঘোষাল আমাদের সামনে বসিয়া হিজিবিজি কাটিতেছিল।
রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘আপনার নাম দেখে মনে হল আপনি হয়তো কিছু জানেন। তাই এলাম।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক। এবার আমি যা জানি শুনুন।’
ব্যোমকেশ কাল সকালে ডাক্তার রক্ষিতের আগমন হইতে সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বক বর্ণনা করিল। রমাপতিবাবু গাঢ় মনোযোগ দিয়া শুনিলেন; ব্যোমকেশ কাহিনী শেষ করিলে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বলিলেন, ‘সন্দেহজনক বটে। কিন্তু বিশু পালের কোনো মোটিভ পাচ্ছি না। তার ওপর লোকটা পঙ্গু।—আপনার কি মনে হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। কাঁটার সময় মৃত্যু হয়েছে জানেন কি?’
‘পুলিস সার্জন বলছেন, রাত্ৰি ন’টার পর এবং বারোটার আগে।’
‘হুঁ-ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘আমার মনে হয়, বিশু পাল সত্যি পঙ্গু্, কিনা ভাল করে যাচাই করে দেখা উচিত।’
রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘তা বটে। আর কাউকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না। তখন বিশু পালকেই নেড়েচেড়ে দেখা যাক। আপনার ফোন আছে, আমাকে একবার ব্যবহার করতে দেবেন?’
‘নিশ্চয়। আসুন।’ ব্যোমকেশ তাঁহাকে পাশের ঘরে লইয়া গেল।
কিছুক্ষণ পরে রমাপতিবাবু ফিরিয়াস আসিয়া বলিলেন, ‘পুলিস সার্জনকে বিশু পালের বাড়িতে যেতে বললাম। আমিও যাচ্ছি। আপনারা আসবেন?’
‘বেশ তো, চলুন না।’
আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হইয়া রমাপতিবাবুর সঙ্গে বাহির হইলাম।
বিশু পালের বাড়ির সামনে ঈষৎ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। পুলিস সার্জন বাড়ির দ্বারের কাছে পুলিসের ছাপ-মারা গাড়িতে বসিয়া আছেন, রাস্তায় ভিড় জমিয়াছে। ডাক্তার রক্ষিত দ্বারের কাছে উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। আমরা উপস্থিত হইলে সার্জন সুশীলবাবু গাড়ি হইতে নামিলেন। ডাক্তার রক্ষিত আমাদের দিকে আগাইয়া আসিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু! কী হয়েছে?’
ব্যোমকেশ দুই পক্ষের পরিচয় করাইয়া দিল। রমাপতিবাবু ডাক্তার রক্ষিতকে বলিলেন, ‘পুলিসের ডাক্তার বিশু পালকে পরীক্ষা করে দেখতে চান। আপনার আপত্তি আছে?’
ডাক্তার রক্ষিত ক্ষণেক অবাক হইয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘আপত্তি! বিন্দুমাত্র না। কিন্তু কেন? কি হয়েছে?’
রমাপতিবাবু বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল নামে এক ব্যক্তিকে কাল রাত্রে কেউ খুন করেছে।’
ডাক্তার রক্ষিত প্রতিধ্বনি করিলেন, ‘অভয় ঘোষালকে খুন করেছে! ও–বুঝেছি, আপনাদের সন্দেহ বিশুবাবু অভয় ঘোষালকে খুন করেছেন।’ তাঁর মুখে একটু শুষ্ক হাসি দেখা দিল— ‘অর্থাৎ বিশুবাবুর পক্ষাঘাত সত্যিকার পক্ষাঘাত নয়, ভান মাত্র। বেশ তো আসুন, পরীক্ষা করে দেখুন!’
আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিলাম।
দ্বিতলে সেরেস্তা বসিয়াছে। ত্রিতলে সিঁড়ির মুখে গুখা সমাসীন। তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া ডাক্তার রক্ষিত বন্ধ দরজায় টোকা দিলেন। দরজা অল্প খুলিয়া বিশু পালের স্ত্রী ভয়ার্তা চোখে চাহিলেন। সমস্ত প্রক্রিয়াই কাল সন্ধ্যার মত।
বিশু পালের স্ত্রী পাশের ঘরে চলিয়া গেলেই, আমরা পাঁচজন ঘরে প্রবেশ করিলাম। ডাক্তার রক্ষিত আলো জ্বালিয়া দিলেন।
বিছানায় বিশু পাল বাল্যাপোশ জড়াইয়া শুইয়া আছেন, কলহশীর্ণ কষ্ঠে বলিয়া উঠলেন, ‘কী চাই। ডাক্তার, এত লোক কেন?’
ডাক্তার রক্ষিত তাঁহার শয্যাপার্শ্বেনত হইয়া বলিলেন, ‘পুলিসের পক্ষ থেকে ডাক্তার এসেছেন, আপনাকে পরীক্ষা করতে চান।’
বিশু পালের কণ্ঠস্বর আরও তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল, ‘কেন? পুলিসের ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করতে চায় কেন?’
ডাক্তার রক্ষিত ধীর স্বরে কহিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে, তাই–’
বিশু পালের ঊর্ধ্বাঙ্গ ধড়ফড় করিয়া উঠিল, ‘কে খুন হয়েছে! কী বললে তুমি ডাক্তার?’
ডাক্তার আবার বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে।’
বিশু পালের মুখে পরিত্রাণের আলো ক্ষণেক ফুটিয়া উঠিয়াই মুখ আবার অন্ধকার হইয়া গেল; তিনি স্খলিত স্বরে বলিলেন, ‘অভয় ঘোষাল খুন হয়েছে! কিন্তু— আমি যে তাকে ত্ৰিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছি, সুদে-আসলে তেত্রিশ হাজার দাঁড়িয়েছে। আমার টাকার কি হবে?’
ডাক্তার নীরস কণ্ঠে বলিলেন, ‘টাকার কথা পরে ভাববেন। এখন এরা এসেছেন যাচাই করতে সত্যি সত্যি আপনার পক্ষাঘাত হয়েছে কিনা।’
‘তার মানে?’ বিশু পাল তীব্র চক্ষু ফিরাইয়া আমাদের পানে চাহিলেন।
রমাপতিবাবু খাটের ধারে আগাইয়া গেলেন, শান্তভাবে বলিলেন, ‘দেখুন, আমাদের কোনো মতলব নেই। আমাদের ডাক্তার কেবল আপনাকে পরীক্ষা করে দেখতে চান। আপনার আপত্তি আছে কি?’
‘আপত্তি! কিসের আপত্তি! পুলিসের ডাক্তার আমার রোগ সারিয়ে দিতে পারবে?’
সুশীলবাবু বলিলেন, ‘তা-চেষ্টা করে দেখতে পারি।’