দুষ্টচক্র

আরো কিছুক্ষণ সওয়াল জবাবের পর বিশু পাল রাজী হইলেন। সুশীলবাবু তাঁহার অঙ্গ হইতে বালাপোশ সরাইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলেন। বিশু পালের পা দু’টি পক্ষাঘাতে অবশ‌, ঊর্ধ্বাঙ্গ সচল আছে। সুশীলবাবু পায়ে ভূঁচ ফুটাইয়া দেখিলেন‌, কোনো সাড়া পাইলেন না। তারপর আরো অনেকভাবে পরীক্ষা করিলেন; নাড়ি দেখিলেন‌, রক্ত-চাপ পরীক্ষা করিলেন‌, ডাক্তার রক্ষিতকে নানাপ্রকার প্রশ্ন করিলেন। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বিশু পালের গায়ে বালাপোশ মুড়িয়া দিলেন।

তাঁহার পরীক্ষাকালে এক সময় আমার দৃষ্টি অন্দরের দিকে সঞ্চালিত হইয়াছিল। দেখিলাম বিশুবাবুর স্ত্রী দরজা একটু ফাঁক করিয়া নিষ্পলক চোখে স্বামীর দিকে চাহিয়া আছেন। তাঁহার উদ্বেগ যেন স্বাভাবিক উদ্বেগ নয়‌, একটা বিকৃত ভয়ার্ত উত্তেজনা—

সুশীলবাবু বলিলেন‌, ‘দেখা হয়েছে। চলুন‌, যাওয়া যাক।’

আমরা দ্বারের দিকে ফিরিলাম। পিছন হইতে বিশু পালের গলা আসিল‌, ‘কেমন দেখলেন? সারবে রোগ?’

সুশীলবাবু একটু অপ্রস্তুতভাবে বলিলেন‌, ‘সারতে পারে। আপনার ডাক্তারবাবু ভালই চিকিৎসা করছেন। — আচ্ছা‌, নমস্কার।’

পুলিসের গাড়িতে বাসায় ফিরিবার পথে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘তাহলে রোগটা যথার্থ অভিনয় নয়।’

সুশীলবাবু বলিলেন‌, ‘না‌, অভিনয় নয়।’

সেদিন সারা দুপুর ব্যোমকেশ উদ্‌ভ্রান্ত চক্ষে কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া তক্তপোশে পড়িয়া রহিল এবং অসংখ্য সিগারেট ধ্বংস করিল। অপরাহ্নে যখন চা আসিল‌, তখনো সে উঠিল না দেখিয়া আমি বলিলাম, ‘পুলিস তো তোমাকে অভয় ঘোষের খুনের তদন্ত করতে ডাকেনি, তবে তোমার এত ভাবনা কিসের?’

সে বলিল‌, ‘ভাবনা নয়‌, অজিত‌, বিবেকের দংশন।’

তারপর সে হঠাৎ উঠিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল। শুনিলাম কাহাকে ফোন করিতেছে। মিনিট কয়েক পরে যখন ফিরিয়া আসিল‌, দেখিলাম তাহার মুখ একটু প্রফুল্প হইয়াছে।

‘কাকে ফোন করলে?’

‘ডাক্তার অসীম সেনকে।’

ডাক্তার অসীম সেনের সঙ্গে ‘খুঁজি খুঁজি নারি ব্যাপারে আমাদের পরিচয় হইয়াছিল।

ব্যোমকেশ এক চুমুকে কবোঞ্চ চা গলাধঃধরণ করিয়া বলিল‌, ‘চল‌, বেরুনো যাক।’

‘কোথায়?’

‘বিশু পালের বাড়ি।’

বিশু পালের বাড়িতে কেরানির দিনের কাজ শেষ করিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিতেছে। ডাক্তার রক্ষিত রোগী দেখার ঘরে টেবিলের উপর পা তুলিয়া দিয়া সিগারেট টানিতেছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া ত্বরিতে পা নামাইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার রোগী কেউ নেই দেখছি। একবার ওপরে চলুন‌, আপনার সামনে বিশুবাবুকে দুটো কথা বলব।’

ডাক্তার প্রসন্ন নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, তারপর বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া আমাদের উপরে লইয়া চলিলেন।

গুর্খা অন্তৰ্হিত হইয়াছে‌, বিশুবাবুর ঘরের দ্বার খোলা। আমরা প্রবেশ করিলাম। আজ আর আলো জ্বলিবার প্রয়োজন হইল না‌, খোলা জানোলা দিয়া পর্যাপ্ত আলো আসিতেছে। বিশু পালের অপঘাত-মৃত্যুভয় কাটিয়াছে।

তিনি পিঠের নীচে কয়েকটা বালিশ দিয়া শয্যায় অর্ধশয়ান ছিলেন‌, আমাদের পদশব্দে চুকিতে ঘাড় ফিরাইলেন।

ব্যোমকেশ শয্যার পাশে গিয়া কিছুক্ষণ বিশু পালের মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল‌, ‘খুব খেলা দেখালেন আপনি।’

বিশু পালের চক্ষু দু’টি প্যাঁচার চোখের মত ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল। ব্যোমকেশ দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল‌, ‘ডাক্তারকে দলে টেনেছিলেন‌, তার কারণ ডাক্তার না হলে আপনার কার্যসিদ্ধি হত না। কিন্তু আমাকে দলে টানলেন কেন? আমি আপনার পক্ষে সাক্ষী দেব এই জন্যে?’

ডাক্তার এতক্ষণ আমাদের পিছনে ছিলেন‌, এখন লাফাইয়া সামনে আসিলেন‌, উগ্র কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘এসব কী বলছেন আপনি! আমার নামে কী বদনাম দিচ্ছেন!’

খোঁচা খাওয়া বাঘের মত ব্যোমকেশ তাঁহার দিকে ফিরিল‌, ‘ডাক্তার‌, প্রোকেন নামে কোনো ওষুধের নাম শুনেছ?’

ডাক্তার ফুটা বেলুনের মত চুপসিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ আরো কিছুক্ষণ তাঁহার পানে আরক্ত নেত্ৰে চাহিয়া থাকিয়া বিশু পালের দিকে ফিরিল‌, পকেট হইতে একশো টাকার নোট বাহির করিয়া বিছানার উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল‌, ‘এই নিন আপনার টাকা। আমি আপনাদের দু’জনকে ফাঁসিকাঠে তুলতে পারি‌, এই কথাটা ভুলে যাবেন না। আপনাকে দু-দিন হাজতে রাখলেই পক্ষাঘাতের প্রকৃত স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে।’

বিশু পাল প্রায় কাঁদিয়া উঠিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, দয়া করুন। আমি যা করেছি। প্ৰাণের দায়ে করেছি‌, নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে করেছি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এক শর্তে দয়া করতে পারি। আপনাকে এক লক্ষ টাকা প্রতিরক্ষা তহবিলে দান করতে হবে। রাজী আছেন?’

বিশু পাল শীর্ণ কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘এক লক্ষ টাকা।’

‘হ্যাঁ, এক লক্ষ টাকা‌, এক পয়সা কম নয়। কাল সকালে আপনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কে এক লক্ষ টাকা জমা দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। যদি টাকা না দেন—’

‘আচ্ছা‌, আচ্ছা‌, দেবো এক লক্ষ টাকা।’

‘মনে থাকে যেন। কাল বেলা বারোটা পর্যন্ত আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রসিদ দেখার জন্য অপেক্ষা করব।–চল অজিত।’

বাড়িতে ফিরিয়া আর এক দফা চা পান করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম‌, প্রতিরক্ষা তহবিলে এক লক্ষ টাকা চাঁদা খুবই আনন্দের কথা‌, কিন্তু ব্যোমকেশ দুটা খুনীকে হাতে পাইয়া ছাড়িয়া দিল কেন? ব্যোমকেশ বোধ হয় আমার মুখ দেখিয়া মনের কথা বুঝিতে পারিয়াছিল; বলিল‌, ‘বিশু পালকে ছেড়ে না দিয়ে উপায় ছিল না। মোকদ্দমা কোর্টে উঠলেও সে ছাড়া পেয়ে যেতো। হত্যার মোটিভ কেউ বিশ্বাস করত না।’

0 Shares