দুষ্টচক্র

বলিলাম‌, ‘কিন্তু মোটিভটা তো খাঁটি?’

‘বিশু পালের দিক থেকে খাঁটি‌, সে সত্যিই নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে অভয় ঘোষালকে খুন করেছিল। কিন্তু জুরী বিশ্বাস করত না‌, হেসে উড়িয়ে দিত।’

‘আচ্ছা‌, একটা কথা বলো। আত্মরক্ষার জন্যে নরহত্যা করলে দোষ নেই আইনে একথা বলে, কেমন? তাহলে বিশু পোল অভয় ঘোষালকে খুন করে কী দোষ করেছে?’

‘আত্মরক্ষার জন্যে নরহত্যার অধিকার মানুষের আছে‌, কিন্তু তিন মাস ধরে ষড়যন্ত্র করে নরহত্যা করলে আইন তা স্বীকার করবে না। বিশু পাল তা জানত বলেই এত সাবধানে আট-ঘাট বেঁধে কাজে নেমেছিল।’

‘ব্যাপার বুঝলাম। তবু তুমি সব কথা পরিষ্কার করে বলে।’

ব্যোমকেশ তখন বলিতে আরম্ভ করিল—

‘অভয় ঘোষালকে কাল আমরা দেখেছিলাম। মুখে হাসি লেগে আছে‌, কিন্তু চোখে জল্লাদের নিষ্ঠুরতা। লোকটা সত্যিকার খুনী। ওর সম্বন্ধে আমরা যা শুনেছি তা একবর্ণ মিথ্যে নয়।

‘বিশু পাল মিষ্টি কথায় ভুলে অভয় ঘোষালকে ত্ৰিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিল। তারপর যখন ধার শোধ করার পালা এল‌, তখন আর অভয় ঘোষালের দেখা নেই। কে কার টাকা ধারে! ‘বিশু পাল তখনো অভয় ঘোষালকে পুরোপুরি চিনত না‌, সে একদিন তার বাড়িতে গিয়ে তার চৌদ্দী-পুরুষান্ত করল। অভয় ঘোষাল একটি কথা বলল না‌, কেবল তার পানে চেয়ে রইল। সেই চাউনি দেখে বিশু পাল ভয় পেয়ে গেল। সে বুঝতে পারল অভয় ঘোষাল কী ধাতুর লোক; সে আগেও খুন করেছে‌, এবার তাকে খুন করবে।

‘বিশু পালও কম নয়। সে যখন পাকাপাকি বুঝলো যে অভয় ঘোষাল তাকে খুন না করে ছাড়বে না‌, তখন সে ঠিক করল অভয় ঘোষালকে সে আগে খুন করবে। তার টাকা মারা যাবার ভয় নেই‌, কারণ অভয় ঘোষালের একটা বাড়ি আছে‌, সেটা ক্রোক করে টাকা আদায় করা যাবে।

‘খুন করার ব্যাপারে বিশু পালের একটা সুবিধা ছিল। সে জানত যে অভয় ঘোষাল তাকে খুন করতে চায়‌, কিন্তু বিশু পাল যে অভয় ঘোষালকে খুন করতে চায়‌, একথা অভয় ঘোষাল জানত না। তাই সে সাবধান হয়নি।

‘বিশু পালের বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হল। সিঁড়ির মুখে গুখ মোতায়েন হল। তারপর বিশু পাল প্ল্যান ঠিক করতে বসল।

‘নীচের তলার ভাড়াটে ডাক্তার সুরেশ রক্ষিত। বেশ বোঝা যায়। তার প্র্যাকটিস নেই। সে বাড়িভাড়া দিতে পারে না‌, তাই বিশু পালের খাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশু পাল তাকে ডেকে নিজের প্ল্যান বলল। ডাক্তারের গলায় ফাঁস‌, সে রাজী হল।

‘বিশু পাল নতুন আসবাব কিনে ডাক্তারের ডিসপেন্সারি সাজিয়ে দিল‌, যাতে মনে হয় ডাক্তার হেঁজিপোঁজি ডাক্তার নয়‌, তার বেশ পসার আছে। তারপর বিশু পালের পক্ষাঘাত হল।

‘আজকাল ডাক্তারি শাস্ত্রের অনেক উন্নতি হয়েছে। আগে অপারেশনের জন্যে রুগীকে অজ্ঞান করতে হলে ক্লোরোফর্ম দিতে হতো‌, এখন আর তা দরকার হয় না। প্রোকেন জাতীয় এক রকম ওষুধ বেরিয়েছে‌, মেরুদণ্ডের স্থান-বিশেষে ইনজেকশন দিলে শরীরের স্থান-বিশেষ অসাড় হয়ে যায়; তখন শরীরের সেই অংশে স্বচ্ছন্দে অপারেশন করা যায়‌, রোগী ব্যথা অনুভব করে না।

‘ডাক্তার রক্ষিত তাই করল‌, বিশু পালের পা দুটো অসাড় হয়ে গেল। তখন একজন নামকরা বড় ডাক্তারকে ডাকা হল; তিনি দেখলেন পক্ষাঘাত‌, সেই রকম ব্যবস্থা করে গেলেন।

‘প্রোকেন জাতীয় ওষুধের ফল পাঁচ-ছয় ঘণ্টা থাকে। তারপর আর থাকে না। কিন্তু সে খবর বাইরের লোক জানে না‌, কেবল বিশু পালের স্ত্রী আর ডাক্তার জানে। কেরানিরা দোতলায় আসে‌, তারা জানতে পারে মালিকের পক্ষাঘাত হয়েছে। সেরেস্তাদার ঘরে ঢুকতে পায় না‌, দোরের কাছ থেকে দেখে যায় মালিক বিছানায় পড়ে আছে। কারুর অবিশ্বাস হয় না‌, অবিশ্বাসের কোন কারণ নেই।

‘কিন্তু বিশু পাল ঝানু লোক‌, সে কাঁচা কাজ করবে না। নিরপেক্ষ নির্লিপ্ত সাক্ষী চাই; এমন সাক্ষ্মী চাই যাদের কথা কেউ অবিশ্বাস করবে না। কাল সকলে সে ডাক্তারকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালো। আমি যেতে রাজী হলাম। ডাক্তার ফিরে গিয়ে বেলা একটা আন্দাজ বিশু পালের শিরদাঁড়ায় প্রোকেন ইনজেকশন দিল।

‘আমরা পাঁচটার সময় গিয়ে দেখলাম বিশু পাল শয্যাশায়ী‌, উত্থানশক্তি রহিত। সে তার দুঃখের কথা আমাকে শোনালো‌, তারপর একশো টাকা দক্ষিণা দিয়ে বিদায় করল। তার মতলব ঠিক করা ছিল‌, কাল রাত্রেই অভয়কে খুন করবে।

‘আমি অভয়ের ঠিকানা নিয়েছি সে খবর ডাক্তার বিশু পালকে জানালো। বিশু পালের ভাবনা হল, আমরা যদি বেশি রাত পর্যন্ত অভয় ঘোষালের বাড়িতে থাকি, তাহলে তার প্লান ভেস্তে যাবে। সে ডাক্তারকে পাঠালো আমাদের ওপর নজর রাখতে; ডাক্তার ট্যাক্সিতে অভয় ঘোষালের বাড়ির সামনে এসে অপেক্ষা করতে লাগল‌, তারপর আমরা যখন অভয়ের বাড়ি থেকে বেরুলাম তখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল। লাইন ক্লিয়ার!

‘সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ বিশু পালের শরীরের জড়ত্র কেটে গেল‌, সে চাঙ্গা হয়ে উঠল।

‘রাত্রি আটটার সময় একটা শুখা চলে যায়‌, দ্বিতীয় শুখা আসে। দশটার সময়। বিশু পাল আন্দাজ ন’টার সময় বাড়ি থেকে বেরুলো‌, বোধ হয়। র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে বেরিয়েছিল‌, হাতে ছিল শুনাৰ্ছচের মত একটা অস্ত্র। গত তিন মাসে সে অভয় ঘোষালের চাল-চলন সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে রেখেছিল। বাড়িতে একটা ঝি ছাড়া আর কেউ থাকে না; অভয় ঘোষাল নটর সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে যায়; সদর দরজা ভেজানো থাকে‌, চাকরানী বোধ হয় দশটার পর রান্নাঘরের কাজকর্ম সেরে সদর দরজা বন্ধ করে।

‘সুতরাং বিশু পালের কোনই অসুবিধা হল না। অভয় ঘোষালকে খুন করে সে দশটার আগেই নিজের বাড়িতে ফিরে এল; কেউ জানতে পারল না। যদি কেউ তাকে দেখে ফেলত। তাহলেও বিশু পালের অ্যালিবাই ভাঙা শক্ত হতো। যে লোক তিন মাস পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী সে খুন করতে যাবে কি করে? খুন করার মোটিভ কোথায়?

0 Shares