পথের কাঁটা

ব্যোমকেশ নিজের বুক-পকেট হইতে একটা পুলিস হুইস্‌ল বাহির কইয়া সজোরে তাহাতে ফুঁ দিল, তারপর আমাকে বলিল,–“অজিত, বাইসিক্লখানা তুলে সরিয়ে রাখো। কিন্তু সাবধান, ওর ঘণ্টিতে হাত দিও না, বড় ভয়ানক জিনিস!”

প্রফুল্ল রায় হাসিল,–“সবই জানে দেখছি, আপনি অসাধারণ লোক। আপনাকেই ভয় ছিল, তাই তো আজ এই ফাঁদ পেতেছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনি একা আসবেন, নিভৃতে সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু আপনি সব দিক দিয়েই দাগা দিলেন। ভাল অভিনয় করতে পারি বলে আমার অহঙ্কার ছিল; কিন্তু আপনি আরও উচ্চশ্রেণীর আর্টিস্ট। আপনি আমার ছদ্মবেশ খুলে আমার মনটাকে উলঙ্গ করে আজ সকালবেলা দেখে নিয়েছিলেন আর আমি শুধু আপনার মুখোশটাই দেখেছিলাম!–যাক, গলাটা বেজায় শুকিয়া গেছে। একটু জল পাব কি?”

ব্যোমকেশ বলিল,–“জল এখানে নেই, থানায় গিয়ে পাবেন।” প্রফুল্ল রায় ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল,–“তাও তো বটে, জল এখানে পাওয়া যায় কোথা!” কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পানের ডিবাটার দিকে একটা সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,–“একটা পান পেতে পারি না কি? অবশ্য আসামীকে পান খাওয়াবার রীতি নেই সে আমি জানি, কিন্তু পেলে তৃষ্ণাটা নিবারণ হত।”

ব্যোমকেশ আমাকে ইঙ্গিত করিল, আমি ডিবা হইতে দু’টা পান তাহার মুখে পুরিয়া দিলাম। পান চিবাইতে চিবাইতে প্রফুল্ল রায় বলিল,–“ধন্যবাদ; বাকী দুটো আপনারা ইচ্ছা করিলে খেতে পারেন।”

ব্যোমকেশ উৎকর্ণভাবে পুলিসের আগমনশব্দ শুনিতেছিল, অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়িল। দূরে মোটর-বাইকের ফট্‌ ফট্‌ শব্দ শুনা গেল। প্রফুল্ল রায় বলিল,–“পুলিস তো এসে পড়ল। আমাকে তাহলে ছাড়বেন না?”

ব্যোমকেশ বলিল,–“ছাড়ব কি রকম?”

প্রফুল্ল রায় ঘোলাটে রকম হাসিয়া পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল,–“পুলিসে দেবেবই?”

“দেব বৈকি!”

“ব্যোমকেশবাবু, বুদ্ধিমান লোকেরও ভুল হয়। আপনি আমাকে পুলিসে দিতে পারবেন না–” বলিয়া রাস্তার উপর ঢলিয়া পড়িল।

একটা মোটর-বাইক সশব্দে আসিয়া পাশে থামিল, একজন ইউনিফর্ম-পরা সাহেব তাহার উপর হইতে লাফাইয়া পড়িয়া বলিল,–“What’s up? Dead?”

প্রফুল্ল রায় নিষ্প্রভ চক্ষু খুলিয়া বলিল,–“এ যে খোদ কর্তা দেখছি! টু লেট্‌ সাহেব, আমায় ধরতে পারলে না। ব্যোমকেশবাবু, পানটা খেলে ভাল করতেন, একসঙ্গে যাওয়া যেত। আপনার মত লোককে ফেলে যেতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে!” হাসিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া প্রফুল্ল রায় চক্ষু মুদিল। তাহার মুখখানা শক্ত হইয়া গেল।

ইতিমধ্যে এক লরি পুলিস আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। কমিশনার সাহেব নিজে হাতকড়ি লইয়া অগ্রসর হইতেই ব্যোমকেশ প্রফুল্ল রায়ের মাথার কাছ হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“হাতকড়ার দরকার নেই। আসামী পালিয়েছে।”

আমি আর ব্যোমকেশ আমাদের চিরাভ্যস্ত বসিবার ঘরটিতে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়াছিলাম। খোলা জানালা দিয়া সকালবেলার আলো ও বাতাস ঘরে ঢুকিতেছিল। ব্যোমকেশ একটি বাইসিক্লের বেল্‌ হাতে লইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতেছিল। টেবিলের উপর একখানা সরকারী খাম খোলা অবস্থায় পড়িয়াছিল।

ব্যোমকেশ ঘণ্টির মাথাটা খুলিয়া ভিতরের যন্ত্রপাতি সপ্রশংস নেত্রে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল,–“কি অদ্ভুত লোকটার মাথা। এ রকম একটা যন্ত্র যে তৈরী করা যায়, এ কল্পনাও বোধ করি আজ পর্যন্ত কারুর মাথায় আসেনি। এই যে পাকানো স্প্রিং দেখছ, এটি হচ্ছে বন্দুকের বারুদ,–কি নিদারুণ শক্তি এই স্প্রিংএর! কি ভয়ঙ্কর অথচ কি সহজ। এই ছোট্ট ফুটোটি হচ্ছে এর নল,–যে পথ দিয়ে গুলি বেরোয়। আর এই ঘোড়া টিপলে দু’ কাজ একসঙ্গে হয়, ঘণ্টিও বাজে, গুলিও বেরিয়ে যায়। ঘণ্টির শব্দে স্প্রিংএর আওয়াজ চাপা পড়ে। মনে আছে–সেদিন কথা হয়েছিল–শব্দে শব্দ ঢাকে গন্ধ ঢাকে কিসে? এই লোকটা যে কত বড় বুদ্ধিমান, সেইদিন তার ইঙ্গিত পেয়েছিলুম।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–“আচ্ছা, পথের কাঁটা আর গ্রামোফোন পিন যে একই লোক, এ তুমি বুঝলে কি করে?”

ব্যোমকেশ বলিল,–“প্রথমটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ক্রমশঃ যেন নিজের অজ্ঞাতসারে ও দুটো মিলে এক হয়ে গেল। দেখ, পথের কাঁটা কি বলছে? সে খুব পরিষ্কার করেই বলছে যে, যদি তোমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে কোনও প্রতিবন্ধক থাকে তো সে তা দূর করে দেবে–অবশ্য কাঞ্চন বিনিময়ে। পারিশ্রমিকের কথাটা স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও, এটা যে তার অনাহারী পরহিতৈষা নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। তারপর এ দিকে দেখ, যারা গ্রামোফোন পিনের ঘায়ে মরেছেন, তাঁরা সকলেই কারুর না কারুর সুখের পথে কাঁটা হয়ে বে’চেছিলেন। আমি মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনের ওপর কোনও ইঙ্গিত করতে চাই না, কারণ যে-কথা প্রমাণ করা যাবে না, সে কথা বলে কোনও লাভ নেই। কিন্তু এটাও লক্ষ্য না করে থাকা যায় না যে, মৃত ব্যক্তিরা সকলেই অপুত্রক ছিলেন, তাঁদের উত্তরাধিকারী কোনও ক্ষেত্রে ভাগ্নে, কোনও ক্ষেত্রে ভাইপো, কোনও ক্ষেত্রে বা জামাই। আশুবাবু এবং তাঁর রক্ষিতার উপাখ্যান থেকে এই ভাইপো-ভাগ্নে-জামাইদের মনোভাব কতক বোঝা যায় না কি?

“তবেই দেখা যাচ্ছে, পথের কাঁটা আর গ্রামোফোন পিন বাইরে পৃথক হলেও বেশ স্বচ্ছন্দে অবলীলাক্রমে জোড় লেগে যাচ্ছে–ভাঙা পাথর বাইর দুটো অংশ যেমন সহজে জোড় লেগে যায়। আর একটা জিনিস প্রথম থেকেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল–একটার নামের সঙ্গে অন্যটার কাজের সাদৃশ্য। এদিকে ‘পথের কাঁটা’ নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে আর ওদিকে পথের ওপর কাঁটার মতই একটা পদার্থ দিয়ে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। মিলটা সহজেই চোখে পড়ে না কি?”

আমি বলিলাম,–“হয়তো পড়ে, কিন্তু আমার পড়েনি।”

ব্যোমকেশ অধীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল,–“এ সব তো খুব সহজ অনুমানের বিষয়। আশুবাবুর কেস হাতে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আসল সমস্যা দাঁড়িয়েছিল–লোকটা কে? এইখানেই প্রফুল্ল রায়ের অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রফুল্ল রায়কে যারা টাকা দিয়েছে খুন করবার জন্যে, তারাও জানতে পারেনি, লোকটা কে এবং কি করে সে খুন করে। আত্মগোপন করবার অসাধারণ ক্ষমতাই ছিল তার প্রধান বর্ম। আমি তাকে কস্মিনকালেও ধরতে পারতুম কিনা জানি না, যদি না সে আমার মন বোঝবার জন্যে সেদিন নিজে এসে হাজির হত।

“কথাটা একটু বুঝিয়ে বলি। তুমি যেদিন পথের কাঁটার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়েছিলে, সেদিন তোমার ভাবভঙ্গী দেখে তার সন্দেহ হয়। তবু সে তোমাকে চিঠি গছিয়ে দিয়ে গেল, তারপর অলক্ষ্যে তোমার অনুসরণ করলে। তুমি যখন এই বাড়ীতে এসে উঠলে তখন তার আর সন্দেহ রইল না যে, তুমি আমারই দূত। আশুবাবুর কেস আমার হাতে এসেছে, তা সে জানত, কাজেই তার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে, আমি অনেক কথাই জানতে পেরেছি। অন্য লোক হলে কি করত বলা যায় না–হয়তো এ কাজ ছেড়েছুড়ে দিয়ে পালিয়ে যেত; কিন্তু প্রফুল্ল রায়ের অসীম দুঃসাহস–সে আমার মন বুঝতে এল। অর্থাৎ আমি কতটা জানি এবং পথের কাঁটা সম্বন্ধে কি করতে চাই, তাই জানতে এল। এতে তার বিপদের কোন আশঙ্কা ছিল না, কারণ প্রফুল্ল রায়ই যে পথের কাঁটা এবং গ্রামোফোন-পিন, তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং জানলেও তা প্রমাণ করতে পারতুম না।–শুধু একটি ভুল প্রফুল্ল রায় করেছিল।”

“কি ভুল।”

“সেদিন সকালে আমি যে তারই পথ চেয়ে বসেছিলুম, এটা সে বুঝতে পারেনি। সে যে খোঁজ-খবর নিতে আসবেই, এ আমি জানতুম।”

“তুমি জানতে! তবে আসবামাত্র তাকে গ্রেপ্তার করলে না কেন?”

“কথাটা নেহাৎ ইয়ের মত বললে, অজিত। তখন তাকে গ্রেপ্তার করলে মানহানির মোকদ্দমায় খেসারতৎ দেওয়া ছাড়া আর কোনও লাভ হত না। সে যে খুনী আসামী, তার প্রমাণ কিছু ছিল কি? তাকে ধরার একমাত্র উপায় ছিল–যাকে বলে in the act, রক্তাক্ত হস্তে! আর সেই চেষ্টাই আমি করেছিলুম। বুকে প্লেট বেঁধে দুজনে যে গিয়েছিলুম, সে কি মিছিমিছি?

“যা হোক, প্রফুল্ল রায় আমার সঙ্গে কথা কয়ে বুঝলে যে, আমি অনেক কথাই জানি–শুধু বুঝতে পারলে না যে তাকেও চিনতে পেরেছি। সে মনে মনে ঠিক করলে যে, আমার বেঁচে থাকার নিরাপদ নয়। তাই সে আমাকে একরকম নিমন্ত্রণ করে গেল,–যেন রাত্রে রেসকোর্সের পাশের পথ দিয়ে যাই। সে জানত, একবার তোমাকে পাঠিয়ে ঠকেছি, এবার আমি নিজে যাব। কিন্তু একটা বিষয়ে তার খটকা লাগল, আমি যদি পুলিস সঙ্গে নিয়ে যাই! তাই সে পুলিসের প্রসঙ্গ তুললে। কিন্তু পুলিসের নামে আমি এমনি চটে উঠলুম যে, প্রফুল্ল রায় খুশী হয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল; আমাকে মনে মনে খরচের খায়ায় লিখে রাখলে।

0 Shares