পথের কাঁটা

“ঠিক জানো? কোন সন্দেহ নেই?”

“কোন সন্দেহ নেই।”

দুই হাত পশ্চাতে রাখিয়া মৃদুহাস্যে ব্যোমকেশ বলিল–“কি করে বুঝলে? প্রমাণ কি?”

“প্রমাণ আর কি! ওর মুখে কুটো–”

“কুটো থাকলেই প্রমাণ হয় যে, বাসা বাঁধতে চায়?”

দেখিলাম ব্যোমকেশের ন্যায়ের প্যাঁচে পড়িয়া গিয়াছি।

কহিলাম, “না–তবে–”

“অনুমান। পথে এস। এতক্ষণ তবে দেয়ালা করছিলে কেন?”

“দেয়ালা করিনি। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও, চড়াই পাখি সম্বন্ধে যে অনুমান খাটে, মানুষের বেলাতেও সেই অনুমান খাটবে?”

“কেন নয়?”

“তুমি যদি কুটো মুখে করে একজনের জানলায় উঠে বসে থাক, তাহলে কি প্রমাণ হবে যে তুমি বাসা বাঁধতে চাও?”

“না। তাহলে প্রমাণ হবে যে, আমি একটা বদ্ধ পাগল।”

“সে প্রমাণের দরকার আছে কি?”

ব্যোমকেশ হাসিতে লাগিল। বলিল–“চটাতে পারবে না। কিন্তু কথাটা তোমায় মানতেই হবে–প্রত্যক্ষ প্রমাণ বরং অবিশ্বাস করা যেতে পারে, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত অনুমান একেবারে অমোঘ। তার ভুল হবার জো নেই।”

আমারও জিদ চড়িয়া গিয়াছিল, বলিলাম–“কিন্তু ঐ বিজ্ঞাপন সম্বন্ধে তুমি যে সব উদ্ভট অনুমান করলে, তা আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না।”

ব্যোমকেশ বলিল–“সে তোমার মনের দুর্বলতা, বিশ্বাস করবারও ক্ষমতা চাই। যা হোক, তোমার মত লোকের পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণই ভাল। কাল শনিবার, বিকেলে কোন কাজও নেই। কালই তোমার বিশ্বাস করিয়ে দেবো।”

“কি ভাবে?”

আমাদের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনা গেল। ব্যোমকেশ উৎকর্ণ হইয়া শুনিয়া বলিল,–“অপরিচিত ব্যক্তি–পৌঢ়–মোটামুটি, নাদুস-নুদুস বললেও অত্যুক্তি হবে না–হাতে লাঠি আছে–কে উনি? নিশ্চয়ই আমাদের সাক্ষাৎ চান, কারণ, তেতলায় আমরা ছাড়া আর কেউ থাকে না।” বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিল।

বাহিরের দরজায় কড়া নড়িয়া উঠিল। ব্যোমকেশ ডাকিয়া বলিল–“ভেতরে আসুন–দরজা খোলা আছে।”

দ্বার ঠেলিয়া একটি মধ্যবয়সী স্থুলকায় ভদ্রলোক প্রবেশ করিলেন। তাঁহার হাতে একটি মোটা মলক্কা বেতের রূপার মুঠযুক্ত লাঠি, গায়ে কালো আলপাকার গলাবন্ধ কোট, পরিধানে কোঁচানো থান। গৌরবর্ণ সুশ্রী, মুখে দাড়ি গোঁফ কামানো, মাথার সম্মুখভাগ টাক পড়িয়া পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। তেতলার সিঁড়ি ভাঙিয়া হাঁফাইয়া পড়িয়াছিলেন, তাই ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রথমটা কথা কহিতে পারিলেন না। পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া মুখ মুছিতে লাগিলেন।

ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে আমাকে শুনাইয়া বলিল–“অনুমান! অনুমান!”

আমি নীরবে তাহার শ্লেষ হজম করিলাম। কারণ, এক্ষেত্রে আগন্তুকের চেহারা সম্বন্ধে তাহার অনুমান যে বর্ণে বর্ণে মিলিয়া গিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।

ভদ্রলোকটি দম লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“ডিটেক্‌টিভ ব্যোমকেশবাবু কার নাম?”

মাথার উপর পাখাটা খুলিয়া দিয়া একখানা চেয়ার নির্দেশ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“বসুন! আমারই নাম ব্যোমকেশ বক্সী, কিন্তু ঐ ডিটেক্‌টিভ কথাটা আমি পছন্দ করি না; আমি একজন সত্যান্বেষী। যা হোক, আপনি বড় বিপন্ন হয়েছেন দেখছি। একটি জিরিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নিন্‌, তারপরে আপনার গ্রামোফোন পিনের রহস্য শুনবো।

ভদ্রলোকটি চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইয়া রহিলেন। আমারও বিস্ময়ের অবধি ছিল না। এই পৌঢ় ভদ্রলোকটিকে দেখিবামাত্র তাঁহাকে গ্রামোফোন-পিন রহস্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা কিরূপে সম্ভব হইল, তাহা একেবারেই আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল না। ব্যোমকেশের অদ্ভুত ক্ষমতার অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়াছি, কিন্তু এটা যেন ভোজবাজির মত ঠেকল।

ভদ্রলোক অতিকষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন–“আপনি–আপনি জানলেন কি করে?”

সহাস্যে ব্যোমকেশ বলিল–“অনুমান মাত্র। প্রথমত, আপনি পৌঢ়, দ্বিতীয়ত, আপনি সঙ্গতিপন্ন, তৃতীয়ত, আপনি সম্প্রতি ভীষণ বিপদে পড়েছেন এবং শেষ কথা–আমার সাহায্য নিতে চান। সুতরাং–” কথাটা অসম্পূর্ণ রাখিয়ে ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া বুঝাইয়া দিল যে, ইহার পর তাঁহার আগমনের হেতু আবিষ্কার করা শিশুর পক্ষেও সহজসাধ্য।

এইখানেই বলিয়া রাখা ভাল যে, কিছুদিন হইতে এই কলিকাতা শহরে যে অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার ঘটিতেছিল এবং যাহাকে ‘গ্রামোফোন পিন মিস্ট্রি’ নাম দিয়া শহরের দেশী-বিলাতি সংবাদপত্রগুলি বিরাট হুলস্থুল বাধাইয়া দিয়াছিল; তাহার ফলে কলিকাতাবাসী লোকের মনে কৌতূহল, উত্তেজনা ও আতঙ্কের অবধি ছিল না। সংবাদপত্রের রোমাঞ্চকর ও ভীতিপ্রদ বিবরণ পাঠ করিবার পর চায়ের দোকানের জল্পনা উত্তেজনায় একেবারে দড়িছেঁড়া হইয়া উঠিয়াছিল এবং গৃহ হইতে পথে বাহির হইবার পূর্বে প্রত্যেক বাঙালী গৃহস্থেরই গায়ে কাঁটা দিতে আরম্ভ করিয়াছিল।

ব্যাপারটা এই–মাস দেড়েক পূর্বে সুকীয়া স্ট্রীট নিবাসী জয়হরি সান্ন্যাল নামক জনৈক পৌঢ় ভদ্রলোক প্রাতঃকালে কর্ণওয়ালিস্‌ স্ট্রীট দিয়া পদব্রজে যাইতেছিলেন। রাস্তা পার হইয়া অন্য ফুটপাতে যাইবার জন্য যেমনই পথে নামিয়াছেন, অমনই হঠাৎ মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া গেলেন। সকালবেলা রাস্তায় লোকজনের অভাব ছিল না, সকলে মিলিয়া তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া তুলিয়া আনিবার পর দেখিল তাঁহার দেহে প্রাণ নাই। হঠাৎ কিসে মৃত্যু হইল অনুসন্ধান করিতে গিয়া চোখে পড়িল যে, তাঁহার বুকের উপর একবিন্দু রক্ত লাগিয়া আছে–আর কোথাও আঘাতের কোনও চিহ্ন নাই। পুলিস অপমৃত্যু সন্দেহ করিয়া লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল। সেখানে মরনোত্তর পরীক্ষায় ডাক্তার এক অদ্ভুত রিপোর্ট দিলেন। তিনি লিখিলেন, মৃত্যুর কারণ হৃৎপিণ্ডের মধ্যে একটি গ্রামোফোনের পিন বিঁধিয়া আছে। কেমন করিয়া এই পিন হৃৎপিণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার কৈফিয়তে বিশেষজ্ঞ অস্ত্র চিকিৎসক লিখিলেন, বন্দুক অথবা ঐ জাতীয় কোনও যন্ত্র দ্বারা নিক্ষিপ্ত এই পিন মৃতের সম্মুখ দিক্‌ হইতে বক্ষের চর্ম ও মাংস ভেদ করিয়া মর্মস্থানে প্রবেশ করিয়াছে এবং মৃত্যুও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হইয়াছে।

এই ঘটনা লইয়া সংবাদপত্রে বেশ একটু আন্দোলন হইল এবং মৃতব্যক্তির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনচরিতও বাহির হইয়া গেল। ইহা হত্যাকাণ্ড কি না এবং যদি তাই হয়, তবে কিরূপে এইহা সঙ্ঘটিত হইল, তাহা লইয়া অনেক গবেষণা প্রকাশিত হইল। কিন্তু একটা কথা কেহই পরিষ্কার করিয়া বলিতে পারিলেন না–এই হত্যার উদ্দেশ্য কি এবং যে হত্যা করিয়াছে তাহার ইহাতে কি স্বার্থ! সরকারের পুলিস যে ইহার তদন্তভার গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাও কাগজে প্রকাশ পাইল। চায়ের দোকানের কাজীরা ফতোয়া দিলেন, ও কিছু নয়, লোকটার হার্টফেল করিয়াছিল, কিন্তু উপস্থিত ভাল সংবাদের দুর্ভিক্ষ ঘটায় কাগজওয়ালারা এই নূতন ফন্দি বাহির কইয়া তিলকে তাল করিয়া তুলিয়াছে।

ইহার দিন আষ্টেক পরে শহরের সকল সংবাদপত্রে দেড়-ইঞ্চি টাইপে যে খবর বাহির হইল, তাহাতে কলিকাতার ভদ্র বাঙালী সম্প্রদায় উত্তেজনায় খাড়া হইয়া উঠিয়া বসিলেন। চায়ের বৈঠকের ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের তৃতীয় নয়ন একবারে বিস্ফোরিত হইয়া খুলিয়া গেল। এত প্রকার গুজব, আন্দাজ ও জনশ্রুতি জন্মগ্রহণ করিল যে, বর্ষাকালে ব্যাঙের ছাতাও বোধ করি এত জন্মায় না।

‘দৈনিক কালকেতু’ লিখিল–

আবার গ্রামোফোন্‌ পিন

অদ্ভুত রোমাঞ্চকর রহস্য

কলিকাতার পথঘাট নিরাপদ নয়

“কালকেতুর পাঠকগণ জানেন, কয়েকদিন পূর্বে জয়হরি সান্ন্যাল পথ দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ পড়িয়া গিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। পরীক্ষায় তাঁহার হৃৎপিণ্ড হইতে একটি গ্রামোফোন পিন বাহির হয় এবং ডাক্তার উহাই মৃত্যুর কারণ বলিয়া নির্দেশ করেন। আমরা তখনি সন্দেহ করিয়াছিলাম যে, ইহা সাধারণ ব্যাপার নয়, ইহার ভিতর একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র লুক্কায়িত আছে। আমাদের সেই সন্দেহ সত্যে পরিণত হইয়াছে, গতকল্য অনুরূপ আর একটি লোমহর্ষণ ব্যাপার ঘটিয়াছে। কলিকাতার বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী কৈলাসচন্দ্র মৌলিক কল্য অপরাহ্নে প্রায় সাড়া পাঁচ ঘটিকার সময় মোটরে চড়িয়া গড়ের মাঠের দিকে বেড়াইতে গিয়াছিলেন। রেড রোডের কাছে গিয়া তিনি মোটর থামাইয়া পদব্রজে বেড়াইবার জন্য যেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া কিছুদূর গিয়াছেন, অমনি ‘উঃ’ শব্দ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন। তাঁহার সোফার ও রাস্তার অন্যান্য লোক মিলিয়া তাড়াতাড়ি তাঁহাকে আবার গাড়িতে তুলিল, কিন্তু তিনি আর তখন জীবিত নাই। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সকলেই হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে অল্পকালমধ্যেই পুলিস আসিয়া পড়িল। কৈলাসবাবুর গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি ছিল, পুলিস তাঁহার বুকের কাছে এক বিন্দু রক্তের দাগ দেখিয়া অপঘাত-মৃত্যু সন্দেহ করিয়া তৎক্ষণাৎ লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দেয়। শবব্যবচ্ছেদকারী ডাক্তারের রিপোর্টে প্রকাশ যে, কৈলাসবাবুর হৃৎপিণ্ডে একটি গ্রামোফোন পিন আটকাইয়া আছে, এই পিন তাঁহার সম্মুখদিক্‌ হইতে নিক্ষিপ্ত হইয়া হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করিয়াছে।

0 Shares