পথের কাঁটা

ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া আশুবাবুর স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিল–“আপনি নিশ্চিন্ত হোন; আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আপনার আর কোন ভয় নেই। কাল আপনার একটা মস্ত ফাঁড়া গেছে সত্যি, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আমার কথা শুনে চলেন, তাহলে আপনার প্রাণের কোন আশঙ্কা থাকবে না।”

আশুবাবু দুই হাতে ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া বলিলেন–“ব্যোমকেশবাবু, আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন, প্রাণ বাঁচান, আমি আপনাকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দেব।”

ব্যোমকেশ নিজের চেয়ারে ফিরিয়া বসিয়া মৃদুহাস্যে বলিল–“এ তো খুব ভাল কথা। সবসুদ্ধ তাহলে তিন হাজার হল–গভর্নমেণ্টও দু’হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করছে না? কিন্তু সে পরের কথা, এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। কাল যে সময় আপনার বুকে ধাক্কা লাগল ঠিক সেই সময় আপনি কোনও শব্দ শুনেছিলেন?”

“কি রকম শব্দ?”

“মনে করুন, মোটরের টায়ার ফাটার মত শব্দ।”

আশুবাবু নিঃসংশয়ে বলিলেন–“না।”

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল–“আর কোন রকম শব্দ?”

“আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না।”

“ভেবে দেখুন।”

কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া আশুবাবু বলিলেন–“রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চললে যে শব্দ হয়, সেই শব্দই শুনেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে যেন–যে সময় ধাক্কাটা লাগে, সেই সময় সাইক্লের ঘণ্টির কিড়িং কিড়িং শব্দ শুনেছিলাম।”

“কোন রকম অস্বাভাবিক শব্দ শোনেননি?”

“না?”

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ অন্য প্রশ্ন করিল–“আপনার এমন কোনও শত্রু আছে, যে আপনাকে খুন করতে পারে?”

“না। অন্তত আমি জানি না।”

“আপনি বিবাহ করেননি, সুতরাং ছেলেপুলে নেই। ভাইপোই বোধ হয় আপনার ওয়ারিস?”

একটু ইতস্তত করিয়া আশুবাবু বলিলেন–“না।”

“উইল করেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“কার নামে সম্পত্তি উইল করেছেন?”

আশুবাবুর গৌরবর্ণ মুখ ধীরে ধীরে রক্তাভ হইয়া উঠিতেছিল, তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সঙ্কোচ-জড়িত স্বরে বলিলেন–“আমাকে আর সব কথা জিজ্ঞাসা করুন, শুধু ঐ প্রশ্নটি আমায় করবে না। ওটা আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব কথা–প্রাইভেট–” বলিতে বলিতে অপ্রতিভভাবে থামিয়া গেলেন।

ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আশুবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া শেষে বলিল–“আচ্ছা থাক। কিন্তু আপনার ভাবী ওয়ারিস–তিনি যে-ই হোন–আপনার উইলের কথা জানেন কি?”

“না। আমি আর আমার উকিল ছাড়া আর কেউ জানে না।”

“আপনার ওয়ারিসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়?”

চক্ষু অন্য দিকে ফিরাইয়া আশুবাবু বলিলেন–“হয়।”

“আপনার ভাইপো কতদিন হল জেলে গেছে?”

আশুবাবু মনে মনে হিসাব করিয়া বলিলেন–“তা প্রায় তিন হপ্তা হবে।”

ব্যোমকেশ কিয়ৎকাল ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বসিয়া রহিল। অবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–“আজ তাহলে আপনি আসুন। আপনার ঠিকানা আর ঘড়িটা রেখে যান; যদি কিছু জানবার দরকার হয়, আপনাকে খরব দেব।”

আশুবাবু শঙ্কিতভাবে বলিলেন–“কিন্তু আমার সম্বন্ধে তো কোন ব্যবস্থা করলেন না। ইতিমধ্যে যদি আবার–”

ব্যোমকেশ বলিল–“আপনার সম্বন্ধে ব্যবস্থা এই যে, পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বেরুবেন না।”

আশুবাবু পাণ্ডুর মুখে বলিলেন–“বাড়িতে আমি একলা থাকি–যদি–”

ব্যোমকেশ বলিল–“না, বাড়িতে আপনার কোন আশঙ্কা নেই, সেখানে আপনি নিরাপদ। তবে ইচ্ছে হয়, একজন দারোয়ান রাখতে পারেন।”

আশুবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“বাড়ি থেকে একেবারে বেরুতে পাব না?”

ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল–“একান্তই যদি রাস্তায় বেরুনো দরকার হয়ে পড়ে, ফুটপাথ দিয়ে যাবেন। কিন্তু খবরদার, রাস্তায় নামবেন না। রাস্তায় নামলে আপনার জীবন সম্বন্ধে আমার কোন দায়িত্ব থাকবে না।”

আশুবাবু প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ ললাট ভ্রুকুটি-কুটিল করিয়া বসিয়া রইল। চিন্তা করিবার নূতন সূত্র সে অনেক পাইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাই আমি তাহার চিন্তায় বাধা দিলাম না। প্রায় আধ ঘণ্টা নীরব থাকিবার পর সে মুখ তুলিয়া বলিল–“তুমি ভাবছ, আমি আশুবাবুকে পথে নামতে মানা করলুম কেন এবং বাড়িতে নিরাপদ, এ কথাই বা জানলুম কি করে?”

চকিত হইয়া বলিলাম–“হ্যাঁ।”

ব্যোমকেশ বলিল–গ্রামোফোন-পিন ব্যাপারে একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ–সব হত্যাই রাস্তায় হয়েছে। ফুটপাথেও নয়। রাস্তায় মাঝখানে। এর কারণ কি হতে পারে, ভেবে দেখেছ?”

“না, কি কারণ?”

“এর দুটো কারণ হতে পারে। প্রথমত, রাস্তায় খুন করলে ধরা পড়বার সম্ভাবনা কম–যদিও আপাতদৃষ্টিতে সেটা অসম্ভব বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়, রাস্তায় ছাড়া অন্যত্র তাকে ব্যবহার করা চলে না।”

আমি কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম–“এমন কি অস্ত্র হতে পারে?”

ব্যোমকেশ বলিল–“তা যখন জানতে পারব, গ্রামোফোন-পিন রহস্য তখন আর রহস্য থাকবে না।”

আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসিয়াছিল, বলিলাম–“আচ্ছা, এমন কোন বন্দুক বা পিস্তল যদি কেউ তৈরি করে, যা দিয়ে গ্রামোফোন-পিন ছোঁড়া যায়?”

সপ্রশংস নেত্রে চাহিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“বুদ্ধি খেলিয়েছ বটে, কিন্তু তাতে দু’ একটা বাধা আছে। যে ব্যক্তি বন্দুক কিম্বা পিস্তল দিয়ে খুন করতে চায়, সে বেছে বেছে রাস্তার মাঝখানে খুন করবে কেন? সে তো নির্জন স্থানই খুঁজবে। বন্দুকের কথা ছেড়ে দিই, পিস্তল ছুঁড়লে যে আওয়াজ হয়, রাস্তার গোলমালেও সে আওয়াজ ঢাকা পড়ে না। তা ছাড়া বারুদের গন্ধ আছে। কথায় আছে–শব্দে শব্দ ঢাকে, গন্ধ ঢাকে কিসে?”

আমি বলিলাম–“মনে কর, যদি এয়ার-গান হয়?”

ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল–“এয়ার-গান ঘাড়ে করে খুন করতে যাওয়ার পরিকল্পনায় নূতনত্ব আছে বটে, কিন্তু সুবুদ্ধির পরিচয় নেই। –না হে না, অত সহজ নয়। এর মধ্যে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, অস্ত্র যা-ই হোক ছোঁড়বার সময় তার একটা শব্দ হবেই, সে শব্দ ঢাকা পড়ে কি করে?”

আমি বলিলাম–“তুমিই তো এখনি বলছিলে–শব্দে শব্দ ঢাকে–”

ব্যোমকেশ হঠাৎ সোজা হইয়া বসিয়া বিস্ফারিত নেত্রে আমার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, অস্ফুট স্বরে কহিল–“ঠিক তো–ঠিক তো–”

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম–“কি হল?”

ব্যোমকেশ নিজের দেহটাকে একটা ঝাঁকানি দিয়া যেন চিন্তার মোহ ভাঙিয়া ফেলিল, বলিল–“কিছু না। এই গ্রামোফোন-পিন রহস্য নিয়ে যতই ভাবা যায়, ততই এই ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয় যে, সব হত্যা এক সুতোয় গাঁথা। সবগুলোর মধ্যেই একটা অদ্ভুত মিল আছে, যদিও তা হঠাৎ চোখে পড়ে না।”

“কি রকম?”

ব্যোমকেশ করাগ্রে গণনা করিতে করিতে বলিল–“প্রথমত দেখ, যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা সবাই যৌবনের সীমা অতিক্রম করেছিলেন। আশুবাবু–যিনি ঘড়ির কল্যাণে বেঁচে গেছেন–তিনিও পৌঢ়। তারপর দ্বিতীয় কথা, তাঁরা সকলেই অর্থবান লোক ছিলেন–হতে পারে কেউ বেশী ধনী কেউ কম ধনী, কিন্তু গরীব কেউ নয়। তৃতীয় কথা, সকলেই পথের মাঝখানে হাজার লোকের সামনে খুন হয়েছেন এবং শেষ কথা–এইটেই সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য–তাঁরা সবাই অপুত্রক–”

আমি বলিলাম–“তুমি তাহলে অনুমান কর যে–”

ব্যোমকেশ বলিল–“অনুমান এখনও আমি কিছুই করিনি। এগুলো হচ্ছে আমার অনুমানের ভিত্তি, ইংরাজিতে যাকে বলে premise.”

আমি বলিলাম–“কিন্তু এই ক’টি premise থেকে অপরাধীদের ধরা–”

আমাকে শেষ করিতে না দিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“অপরাধীদের নয় অজিত, অপরাধীর। গৌরবে ছাড়া এখানে বহুবচন একেবারে অনাবশ্যক। খবরের কাগজওয়ালারা ‘মার্ডারস্‌ গ্যাং’ বলে যতই চীৎকার করুন, গ্যাং-এর মধ্যে কেবল একটি লোক আছেন। তিনিই এই নরমেধযজ্ঞের হোতা, ঋত্বিক এবং যজমান। এক কথায়, পরব্রহ্মের মত ইনি, একমেবাদ্বিতীয়ম্‌।”

আমি সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিলাম,–“এ কথা তুমি কি করে বলতে পারো? কোন প্রমাণ আছে?”

ব্যোমকেশ বলিল–“প্রমাণ অনেক আছে, কিন্তু উপস্থিত একটা দিলেই যথেষ্ট হবে। এমন অব্যর্থ লক্ষ্যবেধ করবার শক্তি পাঁচজন লোকের কখনও সমান মাত্রায় থাকতে পারে? প্রত্যেকটি পিন অব্যর্থভাবে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে–একটু উঁচু কিম্বা নীচু হয়নি। আশুবাবুর কথাই ধর, ঘড়িটি না থাকলে ঐ পিন কোথায় গিয়ে পৌঁছত বল দেখি? এমন টিপ কি পাঁচজনের হয়? এ যেন চক্রছিদ্রপথে মৎস্য-চক্ষু বিদ্ধ করার মত,–দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর মনে আছে তো? ভেবে দেখ, সে কাজ একা অর্জুনই পেরেছিল, মহাভারতের যুগেও এমন অমোঘ নিশানা একজন বৈ দু’জনের ছিল না।” বলিয়া হাসিতে হাসিতে সে উঠিয়া পড়িল।

0 Shares