আমরা উঠিলাম। ডাক্তার পালিত আমাদের সঙ্গে মোটর পর্যন্ত আসিলেন, বলিতে বলিতে আসিলেন, ‘খুবলাল ছেলেটা ভাল। তবে-মাঝে মাঝে দু’চার পয়সা চুরি করে, দুটো ভিটামিনের বড়ি কি দুপুরিয়া কুইনিন পকেটে পুরে বাড়ি নিয়ে যায়; ওটা ধর্তব্য নয়, সব কম্পাউণ্ডারই করে। এসব গুরুতর ব্যাপারে ও আছে বলে মনে হয় না।’
ব্যোমকেশ গাড়িতে বসিয়া হঠাৎ গলা বাড়াইয়া বলিল, ‘ডাক্তারবাবু্, শকুন্তলা দেবী ক’মাস অন্তঃসত্ত্বা?’
ডাক্তার পালিত পূর্ণদৃষ্টিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া বলিলেন, ‘তিন মোস।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি খুবই আশ্চর্য হয়েছেন।’
‘আশ্চর্য হবারই কথা।’–বলিয়া তিনি ফিরিয়া চলিলেন।
৬
ডাক্তারখানা হইতে দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ি মোটরে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। এই পাঁচ মিনিট আমাদের মধ্যে একটিও কথা হইল না। সকলেই অন্তনিবিষ্ট হইয়া রহিলাম।
ফটকের বাহিরে গাড়ি থামাইয়া অবতরণ করিলাম। দেউড়িতে টুলের উপর একটা কনস্টেবল বসিয়া ছিল, তড়াক করিয়া উঠিয়া পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন, কম্পাউণ্ডের বাইরেটা ঘুরে দেখা যাক।’ পূর্বে বলিয়াছি বাড়ির চারিদিকে জেলখানার মত উচু পাঁচল। আমরা পাঁচিলে ধার ঘেষিয়া একবার প্রদক্ষিণ করিলাম। সামনের দিকে সদর রাস্তা; দুই পাশে ও পিছনে আম-কাঁঠালের বাগান। এই অঞ্চলে আম-কাঁঠালের বাগানই বেশি এবং সব বাগানই দীপনারায়ণের সম্পত্তি। পূর্বকালে এদিকে বোধহয় লোকবসতি ছিল, কিন্তু দীপনারায়ণের পূর্বপুরুষেরা সমস্ত পাড়াটা ক্রমে ক্বমে আত্মসাৎ করিয়া ফলের বাগানে পরিণত করিয়াছেন। পাড়ায় এখন একমাত্র বাড়ি দীপনারায়ণের বাড়ি। তবু আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সুখ-সুবিধার ত্রুটি নাই; ইলেকট্রিক ও টেলিফোনের তার পাঁচিল ডিঙাইয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছে। এমন কি একটি ডাক-বাক্স লাল কুতা-পরা সিপাহীর মত পাঁচিলের এক কোণে দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছে। চিঠিপত্র ডাকে দিতে হইলে বেশি দূরে যাইতে হইবে না।
প্রাচীর প্রদক্ষিণ করিয়া ব্যোমকেশ কী দেখিল জানি না; দ্রষ্টব্য বস্তু কিছুই নাই। পাশে ও পিছনে আম-কাঁঠালের গাছ দেয়াল পর্যন্ত ভিড় করিয়া আসিয়াছে, দেয়াল ঘেঁষিয়া মাঠের উপর একটি পায়ে-হাঁটা সরু রাস্তা। ডাক-বাক্সের দিক হইতে পাশের দিকে যাইলে একটি খিড়কি দরজা পড়ে, বোধকরি চাকর-বাকিরদের যাতায়াতের পথ। এটি ছাড়া পাশের বা পিছনের দেয়ালে যাতায়াতের অন্য পথ নাই।
খিড়কি দরজা খোলা ছিল, আমরা সেই পথেই ভিতরে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশ প্রবেশ করিবার সময় দরজাটিকে একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। সেকেল ধরনের খর্বকায় মজবুত কবাট, কবাটের পুরু তক্তার উপর মোটা মোটা পেরেক দিয়া গুল বসানো; কিন্তু তা সত্ত্বেও কবাট দু’টি নড়বড়ে হইয়া গিয়াছে। কাবাটের মাথার কাছে শিকল বুলিতেছে, বোধহয় রাত্রিকালে শিকল লাগাইয়া দ্বার বন্ধ করা হয়।
খিড়কি দরজা সম্বন্ধে ব্যোমকেশের অনুসন্ধিৎসা একটু আশ্চর্য মনে হইল; তাহার মন কোন পথে চলিয়াছে ঠিক ধরিতে পারিতেছি না। যাহোক, ভিতরে প্রবেশ করিয়া পাশেই পাঁচিলের লাগীও একসারি ঘর চোখে পড়িল। ঘরগুলি দপ্তরখানা, জমিদারীর কেরানিরা এখানে বসিয়া সেরেস্তার কাজকর্ম করে। আমাদের দেখিতে পাইয়া একটি লোক সেখান হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। লোকটিকে কাল রাত্রে দেখিয়াছি, মাথায় পাগড়ি-বাঁধা ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী।
তিনি ত্বরিতে অগ্রসর হইয়া আসিলেন, খিড়কি দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আলাপ হইল। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখাচ্ছি।’
ম্যানেজারের অভিজ্ঞ চোখে প্রশ্ন জাগিয়া উঠিলেও তিনি মুখে বলিলেন, ‘বেশ তো, বেশ তো, আসুন না। আমি দেখাচ্ছি।’
ব্যোমকেশ খিড়কি দরজার দিকে আঙুল দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, এ দরজাটা কি সব সময়েই খোলা থাকে?’
ম্যানেজার একটু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন, ঘাড় চুলকাইয়া বলিলেন, ‘এঁ—ঠিক বলতে পারছি না, বোধহয় রাত্রে বন্ধ থাকে। কেন বলুন দেখি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘নিছক কৌতুহল।’
এই সময় একজন ভৃত্যকে বাড়ির পিছন দিকে দেখা গেল। ম্যানেজার হাত তুলিয়া তাহাকে ডাকিলেন। ভূত্য আসিলে বলিলেন, ‘বিষুণ, রাত্রে খিড়কি দরজা বন্ধ থাকে?’
বিষুণও ঘাড় চুলকাইল, ‘তা তো ঠিক জানি না হুজুর। বোধহয় শিকল তোলা থাকে। চৌকিদার বলতে পারবে।’
‘ডাক চৌকিদারকে।’ বিষুণ চৌকিদারকে ডাকিতে গেল।
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘রাত্রে চৌকিদার বাড়ি পাহারা দেয়?’
ম্যানেজার বলিলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। দেউড়িতে দারোয়ান থাকে, আর দু’জন চৌকিদার পালা করে পাহারা দেয়।’
অল্পক্ষণ মধ্যে বিষুণ একটি চৌকিদারকে আনিয়া উপস্থিত করিল। চৌকিদার দেখিতে তালপাতার সেপাই, কিন্তু বিপুল গোঁফ ও গালপোট্টার দ্বারা কঙ্কালসার মুখে চৌকিদার সুলভ ভীষণতা আরোপ করিবার চেষ্টা আছে, চোখ দু’টি রাত্ৰিজাগরণ কিম্বা গঞ্জিকার প্রসাদে করমচার মত লাল। ম্যানেজার তাহাকে প্রশ্ন করিলেন, ‘গজাধর সিং, রাত্রে খিড়কির দরজা খোলা থাকে, না বন্ধ থাকে?’
গজাধর ভাঙা গলায় বলিল, ‘ধমন্বিতার, কখনও খোলা থাকে, কখনও জিঞ্জির লাগানো থাকে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তালা লাগানো থাকে না?’
গজাধর বলিল, ‘না। হুজুর, অনেকদিন আগে তালা ছিল, এখন ভুৎলা গিয়া। কিন্তু তাতে ভয়ের কিছু নেই, আমরা দুভাই এমন পাহার দিই যে, একটা চুহা পর্যন্ত হাতায় ঢুকতে পারে না।’