‘বটে! কি ভাবে পাহারা দাও?’
‘রাত্রি দশটা থেকে পাহারা শুরু হয় হুজুর। দশটা থেকে দুটো পর্যন্ত একজন পাহারা দিই, আর দুটো থেকে ছটা পর্যন্ত আর একজন। দেউড়িতে ঘণ্টা বাজে আর আমরা উঠে একবার চক্কর দিই, আবার ঘণ্টা বাজে আবার চক্কর দিই। এইভাবে সারা রাত চক্কর লাগাই, ধর্মাবতার।’
‘তাহলে ঘণ্টা বাজার মাঝখানে কেউ যদি ভিতর থেকে বাইরে যায়। কিম্বা বাইরে থেকে ভিতরে আসে তোমরা জানতে পার না?’
‘বাইরে থেকে কে আসবে হুজুর, কার ঘাড়ে দশটা মাথা?’
‘বুঝেছি। তুমি এখন যেতে পার।’
গজাধর প্রস্থান করিলে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী সাফাইয়ের সুরে বলিলেন, ‘এ বাড়িতে খুব কড়া পাহারার দরকার হয় না; চোর-ছ্যাচাড়েরা জানে। এখানে দারোয়ান চৌকিদার আছে, ধরা পড়লে আর রক্ষে নেই। তাই তারা এদিকে আসে না। আমি আঠারো বছর এই এস্টেটে আছি, কখনো একটা কুটো চুরি যায়নি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি চুরির কথা ভাবছিলাম না। যাহোক, আসুন এবার ওদিকটা দেখা যাক।’
অতঃপর গঙ্গাধর বংশী আমাদের লইয়া চারিদিক ঘুরিয়া দেখাইলেন। দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে মৃত প্রভুর উদ্দেশে শোক প্রকাশ করিলেন; প্রশ্ন না করিয়া মৃত্যুর কারণ জানিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু আমরা তাঁহার কৌতুহলের প্রশ্রয় দিলাম না, গভীর মনঃসংযোগে সরেজমিনে তদারক করিলাম।
বাড়ির সামনের দিকে ফুলের বাগান, পিছনে শাকসব্জীর ক্ষেত। বাড়িটি দ্বিতল এবং চক-মেলানো, প্রায় সাত-আট কাঠা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাড়ির দুই পাশে দ্বিতলে উঠিবার দুইটি লোহার পাকানো সিঁড়ি আছে। এই পথে মেথর ঝাড়ুদার উপরতলা পরিষ্কার রাখে, কারণ পাটনায় এখনও ড্রেনের প্রতিষ্ঠা হয় নাই।
পরিদর্শন শেষ করিয়া সদরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর রতিকান্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ব্যোমকেশের পানে একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিল, ‘বাগানে কী দেখছিলেন? কিছু পেলেন নাকি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিশেষ কিছু না। কেবল এইটুকু জানা গেল যে রাত্তিরে বাড়ির যে-কেউ খিড়কির দরজা খুলে বাইরের লোককে ভিতরে আনতে পারে।’
রতিকান্ত কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, ‘কিন্তু–বর্তমান ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক আছে কি?’
‘থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। চলুন, এবার বাড়ির লোকগুলির সঙ্গে আলাপ করা যাক—‘
বাড়িতে প্রবেশ করিবার উপক্বম করিতেছি, ফট্ফটু শব্দে ঘাড় ফিরাইয়া দেখি ফটকের দিক হইতে একটি মোটর বাইক আসিতেছে। আরূঢ় ব্যক্তিটি অপরিচিত; চেহারাটা সুশ্রী, বয়সী। আন্দাজ পয়ত্ৰিশ। পরিধানে সাদা ফ্ল্যানেলের প্যান্ট, গাঢ় নীল রঙের গরম ক্রিকেট কোট, গলায় লাল পশমের মাফলার, মাথায় রঙচটা ক্রিকেট ক্যাপ। পুরাদস্তুর খেলোয়াড়ের সাজ, দেখিলে মনে হয়। এই মাত্র ক্রিকেটের মাঠ হইতে ফিরিতেছেন।
করিলেন। পাণ্ডেজি ও রতিকাস্তের ললাটে গভীর ভ্রূকুটি দেখিয়া অনুমান করিলাম, ইনি যতবড় খেলোয়াড়ই হোন, পুলিসের প্রতিভাজন নন। পরীক্ষণেই পাণ্ডেজির সম্ভাষণ শুনিয়া বুঝিতে বাকি রহিল না যে এই ব্যক্তিই কুখ্যাত নারীহরণকারী নর্মদাশঙ্কর।
পাণ্ডেজি বলিলেন, নর্মদাশঙ্করবাবু্, আপনার এখানে কী দরকার?’
নর্মদাশঙ্কর সবিনয়ে নমস্কার করিয়া বলিল, ‘ক্রিকেটের মাঠে খবর পেলাম দীপনারায়ণবাবু হঠাৎ মারা গেছেন। শুনলাম নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। শুনে আর থাকতে পারলাম না। ছুটে এলাম। কী হয়েছিল, মিঃ পাণ্ডে?’
পান্ডেজি নীরস কণ্ঠে বলিলেন, ‘মাফ করবেন, এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কোন আলোচনা হতে পারে না। কিন্তু আপনার কি দরকার তা তো বললেন না?’
নর্মদাশঙ্কর মুখখানিকে বিষগ্ন করিয়া বলিল, ‘দরকার আর কি, বন্ধুর বিপদে আপদে খোঁজ-খবর নিতে হয়। শকুন্তলা যে কী দারুণ শোক পেয়েছেন তা তো বুঝতেই পারছি। কাল রাত্রে তাঁকে দেখেছিলাম আনন্দের প্রতিমূর্তি! তখন কে ভেবেছিল যে—তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হবে কি?’
‘দেখা করতে চান কেন?’
‘তাঁকে সহানুভূতি জানানো, দুটো সত্ত্বনার কথা বলা, এছাড়া আর কি? আপনারা নিশ্চয় জানেন শকুন্তলার সঙ্গে আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা আছে।’ শকুন্তলার নামোল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে নর্মদাশঙ্করের চোখে যে ঝিলিক খেলিয়া যাইতে লাগিল তাহা কাহারও দৃষ্টি এড়াইল না।
পাণ্ডেজি চাপা বিরক্তির স্বরে বলিলেন, ‘মাফ করবেন, শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে কারুর দেখা সাক্ষাৎ হবে না, এখন ওসব লৌকিকতার সময় নয়।–রতিকান্ত, ফটকের কনস্টেবলকে বলে দাও, আমাদের অনুমতি না নিয়ে যেন কাউকে ভেতরে আসতে না দেয়।’
পাণ্ডেজির ইঙ্গিতটা এতাই স্পষ্ট যে নর্মদাশঙ্করের চোখে আর এক ধরনের ঝিলিক খেলিয়া গেল, কুটিল ক্রোধের ঝিলিক। কিন্তু সে বিনীতভাবেই বলিল, ‘বেশ, আপনারাই তাহলে শকুন্তলাকে আমার সমবেদনা জানিয়ে দেবেন। আচ্ছা, আজ চলি। নমস্তে।’
নর্মদাশঙ্করের মোটর বাইক ফট্ফট্ করিয়া চলিয়া গেল। রতিকান্ত তাহার বিলীয়মান পৃষ্ঠের দিকে বিরাগপূর্ণ নেত্ৰে চাহিয়া গলার মধ্যে বলিল—’মিটমিটে শয়তান!’ তারপর ফটকের কনস্টেবলকে হুকুম দিতে গেল।
ব্যোমকেশ ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাল রাত্রে নর্মদাশঙ্করবাবু কখন নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন। আপনি লক্ষ্য করেছিলেন কি?’
ম্যানেজার বলিলেন, ‘উনি কখন এসেছিলেন তা ঠিক বলতে পারি না, কিন্তু সাড়ে ছাঁটার সময় এসে দেখলাম, উনি শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে বসে গল্প করছেন। তখনও অন্য কোনও অতিথি আসেননি।’