বহ্নি-পতঙ্গ

‘মাফ করবেন‌, আপনি কোথায় থাকেন?’

ম্যানেজার সম্মুখে রাস্তার ওপারে আঙুল দেখাইয়া বলিলেন‌, ‘ওই আমবাগানের মধ্যে একটা বাড়ি আছে‌, এস্টেটের বাড়ি‌, আমি তাতেই থাকি।’

‘আজ্ঞে না। এ তল্লাটে আর বাড়ি নেই।’

‘আচ্ছা‌, আজ সকালে মৃত্যুর পূর্বে দীপনারায়ণবাবুকে আপনি দেখেছিলেন কি?’

ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী ক্ষুব্ধভাবে মাথা নাড়িলেন—’আজ্ঞে না‌, ডাক্তারবাবু আমার আগেই এসেছিলেন। রবিবারে সেরেস্তা বন্ধ থাকে‌, আমি একটু দেরি করে আসি। এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।’

রতিকান্ত ফিরিয়া আসিলে আমরা সকলে মিলিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। হল-ঘরের মধ্যে ছায়ান্ধকার‌, মানুষ কেহ নাই। আমরা পাঁচজনে প্রবেশ করিয়া পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ম্যানেজারবাবু্‌, আপনাকে আমরা অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। আপনার নিশ্চয় অন্য কাজ আছে—‘

ম্যানেজার মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘আমার আজ কোনই কাজ নেই। আজ রবিবার‌, সেরেস্তা বন্ধ। নেহাৎ অভ্যাসবিশেই এসেছিলাম।’

বোঝা গেল। তিনি আমাদের সঙ্গ ছাড়িবেন না। তিনি গভীর মনঃসংযোগে আমাদের কথা শুনিতেছেন এবং তাহার তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহার চক্ষু দু’টি মধুসঞ্চয়ী ভ্রমরের মত আমাদের মুখের উপর পরিভ্রমণ করিতেছে। কিন্তু তিনি নিজে বাক্যব্যয় করিতেছেন না। গভীর জলের মাছ।

পান্ডেজি ব্যোমকেশের পানে একটি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন‌, ‘ভাল কথা বংশীজি‌, আপনার সেরেস্তায় টাকাকড়ির হিসেব সব ঠিক আছে তো? হয়তো আমাদের পরীক্ষা করে দেখবার দরকার হতে পারে।’

বংশীজি তৎক্ষণাৎ বলিলেন‌, ‘সব হিসেব ঠিক আছে‌, আপনারা যখন ইচ্ছে দেখতে পারেন।’ তারপর একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন‌, ‘কেবল একটা হিসেবের চুক্তি হয়নি—’

‘কোন হিসেব?’

ম্যানেজার বলিলেন‌, ‘আট-দশ দিন আগে দীপনারায়ণজি আমাকে ডেকে হুকুম দিয়েছিলেন। ভাক্তার পালিতকে বারো হাজার টাকা দিতে। টাকাটা ডাক্তারবাবুকে দেওয়া হয়েছে কিন্তু রসিদ নেওয়া হয়নি।’

‘রসিদ নেওয়া হয়নি কেন?’

‘ডাক্তারবাবু টাকাটা ধার হিসাবেই চেয়েছিলেন, কিন্তু দীপনারায়ণজি ঠিক করেছিলেন টাকাটা ডাক্তারবাবুকে পুরস্কার দেবেন‌, তাই রসিদ নিতে মানা করেছিলেন।’

‘ও—’ ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া নীরব রহিল‌, তারপর রতিকান্তকে বলিল‌, ‘এবার তাহলে বাড়ির সকলকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক। তাঁরা কোথায়?

রতিকান্ত বলিল‌, ‘তাঁরা সবাই উপরিতলায়। শোবার ঘর সব ওপরে। আপনারা বসুন‌, আমি একে একে ওঁদের ডেকে নিয়ে আসি। কাকে আগে ডাকব-শকুন্তলা দেবীকে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শকুন্তলা দেবীকে কষ্ট দেবার দরকার নেই‌, আমরাই ওপরে যাচ্ছি। দুচারটে মামুলী কথা জিজ্ঞাসা করা বৈ তো নয়। দেবনারায়ণবাবুও বোধহয় ওপরে আছেন?’

‘হ্যাঁ। চাঁদনী দেবীও আছেন।’

‘তবে চলুন।’ পাশের একটি ছোট ঘর হইতে উপরে উঠিবার সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেলাম।

সিঁড়ির উপরে একটি ঘর‌, তাহার দুইদিকে দুইটি দরজা। উপরতলাটি দুই ভাগে বিভক্ত। আমরা উপরে উঠিলে রতিকান্ত বলিল‌, ‘কোনদিকে যাবেন? এদিকটা দেবনারায়ণবাবুর মহল‌, ওদিকটা দীপনারায়ণবাবুর।’

ব্যোমকেশ কোনদিকে যাইবে ইতস্তত করিতেছে এমন সময় দেবনারায়ণের দিকের দ্বারা দিয়া চাঁদনী বাহির হইয়া আসিল। তাহার হাতে এক বাটি দুধ্‌্‌, কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোেখ মুখ ফুলিয়া উঠিয়াছে। আমাদের দেখিয়া সে সসঙ্কোচে দাঁড়াইয়া পড়িল‌, স্বভাব্যবশত মাথার কাপড় টানিতে গেল‌, তারপর বাড়ির সাম্প্রতিক কায়দা স্মরণ করিয়া থামিয়া গেল। আমাদের মধ্যে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীকে দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া জড়িতস্বরে বলিল‌, ‘চাচিজি আজ সারাদিন এক ফোঁটা জল মুখে দেননি.তাই যাচ্ছি। আর একবার চেষ্টা করতে যদি একটু দুধ খাওয়াতে পারি। চাচাজি তো গেছেন‌, উনিও যদি না খেয়ে প্রাণটা দেন কি হবে বলুন দেখি? বলিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

আমরা থাতমত খাইয়া গেলাম। এই একান্ত ঘরোয়া সেবার মূর্তিটিকে দেখিবার জন্য কেহই যেন প্রস্তুত ছিলাম না। গঙ্গাধর বংশী বিচলিতভাবে গলা ঝাড়া দিয়া বলিলেন‌, ‘যাও বেটি‌, ওঁকে আগে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা কর। কিছু না খেলে কি করে চলবে।’

চাঁদনী দুধ লইয়া চোখ মুছিতে মুছতে চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ বলিল‌, চলুন‌, দেবনারায়ণবাবুর কাছে আগে যাওয়া যাক।’

আমরা দেবনারায়ণের মহলে প্রবেশ করিলাম, ম্যানেজার আমাদের পথ দেখাইয়া লইয়া চলিলেন।

ঘরের পর ঘর‌, সবগুলিই দেশী বিদেশী আসবাবে ঠাসা; কিন্তু কিছুরই তেমন ছিরি-ছাঁদ নাই‌, সবই এলোমেলো বিশৃঙ্খল। অবশেষে বাড়ির শেষ প্রান্তে একটি পদৰ্ণ ঢাকা দরজার সম্মুখীন হইলাম।

ঘরের ভিতর কে আছে তখনও দেখি নাই‌, আমাদের সমবেত পদশব্দে আকৃষ্ট হইয়া একটি লোক পদার্থ সরাইয়া উঁকি মারিল‌, তারপর চিকিতে অন্তহিঁত হইয়া গেল। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি বেশ বড়‌, তিনদিকে জানোলা। মেঝের অর্ধেক জুড়িয়া পুরু গদির উপর ফরাস পাতা‌, তাহার উপর কয়েকটা মোটা মোটা তাকিয়া। দেবনারায়ণ মাঝখানে তাকিয়া পরিবৃত হইয়া বসিয়া আছে‌, তাহার পাশে একটু পিছনে কোঁকড়া-চুল কোঁকড়া-গোঁফ বিদূষক বেণীপ্রসাদ। আমাদের দেখিয়া বেণীপ্রসাদ উঠিয়া দাঁড়াইল।

ম্যানেজার দেবনারায়ণকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন‌, ‘এঁরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ দেবনারায়ণ কোনও কথা না বলিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্যাঙের মত চাহিয়া রহিল।

0 Shares