বহ্নি-পতঙ্গ

ম্যানেজার আমাদের বসিতে বলিলেন। আমি ও ব্যোমকেশ বিছানার পাশে বসিলাম। আর সকলে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ব্যোমকেশ এদিক ওদিক চাহিয়া বলিল‌, ‘ঘরে আর একজন ছিলেন-যিনি পদাৰ্থ ফাঁক করে উঁকি মেরেছিলেন–তিনি কোথায় গেলেন?’

বেণীপ্রসাদ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল‌, ‘তিনি-মানে লীলাধর’–ম্যানেজারের দিকে একটি ক্ষিপ্ত চিকিত চাহনি হানিয়া সে কথা শেষ করিল–’সে পাশের ঘরে গেছে।’

ব্যোমকেশ ভাল মানুষের মত জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘পাশের ঘরে কী আছে?’

বেণীপ্রসাদ বলিল‌, ‘মানে–গোসলখানা।’

ব্যোমকেশ ফিক করিয়া হাসিল‌, ‘বুঝেছি। গোসলখানার লোগাও পাকানো লোহার সিঁড়ি আছে‌, লীলাধরবাবু সেই দিক দিয়ে বাড়ি গেছেন। কেমন?

বেণীপ্রসাদ উত্তর দিল না‌, নিতম্ব চুলকাইতে চুলকাইতে ম্যানেজারের দিকে আড় চোখে চাহিতে লাগিল।

লীলাধর যে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীর পুত্র এবং দেবনারায়ণের সহকারী বিদূষক তাহা আমরা কাল রাত্রে জানিতে পারিয়াছিলাম। দেখিলাম‌, গঙ্গাধর বংশীর মুখ কালো হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি উদগত হৃদয়াবেগ যথাসাধ্য সংযত করিয়া বেণীপ্রসাদকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘তোমরা এখানে কি করছি?’

নিতম্ব ছাড়িয়া বেণীপ্রসাদ এক হাত তুলিয়া বগল চুলকাইতে আরম্ভ করিল‌, বলিল‌, আজ্ঞো-ছোট-মালিকের মন খারাপ হয়েছে তাই আমরা ওঁকে একটু—’

মন খারাপের উল্লেখে দেবনারায়ণের বোধহয় খুড়ার মৃত্যুর কথা মনে পড়িয়া গেল‌, সে হঠাৎ চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। আকাশ-পাতাল হ্যাঁ করিয়া হাতির মত লোকটা কাঁদিতে লাগিল।

কাল দেবনারায়ণের হাসি শুনিয়াছিলাম‌, আজ কান্না শুনিলাম। আওয়াজ প্ৰায় একই রকম‌, যেন এক পাল শেয়াল ডাকিতেছে।

পাঁচ মিনিট চলিবার পর হঠাৎ কান্না আপনিই থামিয়া গেল। দেবনারায়ণ রুমালে চোখ মুছিয়া পানের ডাবা হইতে এক খামচা পান মুখে পুরিয়া চিবাইতে লাগিল। ব্যোমকেশ এতক্ষণ নির্বিকারভাবে দেয়ালে টাঙানো রবি বামার ছবি দেখিতেছিল‌, কান্না থামিলে সহজ স্বরে বলিল‌, ‘দেবনারায়ণবাবু্‌, আপনি মদ খান?

দেবনারায়ণবাবু বলিল‌, ‘নাঃ। আমি ভাঙ‌, খাই।’

‘তবে তাকিয়ার তলায় ওটা কি? বলিয়া ব্যোমকেশ অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

বেণীপ্রসাদ ইতিমধ্যে তেরছাভাবে গোসলখানার দ্বারের দিকে যাইতেছিল‌, এখন সুট করিয়া অন্তহিঁত হইল। আমি নির্দিষ্ট তাকিয়া উল্টাইয়া দেখিলাম‌, তলায় একটি ছিপি-আটা বোতল রহিয়াছে; বোতলের মধ্যে শ্বেতবর্ণ তরল দ্রব্য।

দেবনারায়ণ বোকাটে মুখে বোতলের দিকে একবার দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল‌, ‘ও তো তাড়ি। লীলাধর আর বেণীপ্রসাদ খাচ্ছিল।’

বোতলে তাড়ি! এই প্রথম দেখিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও—আপনার মন প্রফুল্ল করবার জন্য ওঁরা তাড়ি খাচ্ছিলেন। তা সে যাক। বলুন তো‌, আপনি ভাঙা ছাড়া আর কি কি নেশা করেন?’

দেবনারায়ণ খানিকটা জব্দ মুখে দিয়া বলিল‌, ‘আর কিছু না।’

‘কোকেন?’

‘বুকনি? নাঃ।’

‘গাঁজা?

‘নাঃ। গাজাধির গাঁজা খায়।’

‘আচ্ছা‌, যেতে দিন। —আপনার বোধহয় অনেক বন্ধু আছে?’

‘বন্ধু-আছে। লাখো লাখো বন্ধু আছে।’

‘তাই নাকি? তাদের দু’চারটে নাম করুন তো।’

‘নাম? লীলাধর।–বেণীপ্রসাদ-গজাধির সিং–’

‘কোন গজাধর সিং?’

‘চৌকিদার। খুব ভাল ভাঙ খুঁটতে পারে।’

‘আর কে?’

‘আর বদ্রিলাল। রোজ আমার পা টিপে দেয়।’

দেবনারায়ণের বন্ধুরা কোন শ্রেণীর লোক তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বুঝলাম। ডাক্তার পালিতের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব নেই?

দেবনারায়ণের বিপুল শরীর একবার ঝাঁকানি দিয়া উঠিল; সে বিহুলকণ্ঠে বলিল‌, ‘ডাক্তার পালিত। ওকে আমি রাখব না‌, তাড়িয়ে দেব। চাচাকে ও খুন করেছে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকাইয়া মুদিত চক্ষে বসিয়া রহিল‌, তারপর চোখ খুলিয়া বলিল‌, ‘আপনার কাকার মৃত্যুর পর আপনি ষোল আনা সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এখন কি করবেন?’

‘কি করব?—দেবনারায়ণ যেন পূর্বে একথা চিন্তাই করে নাই এমনিভাবে ইতি-উতি তাকাইতে লাগিল। আমি বিস্মিত হইয়া ভাবিলাম‌, দেবনারায়ণ কি সত্যই এতবড় গবেট?

ব্যোমকেশ উঠিয়া পড়িল‌, বলিল‌, চলুন‌, এর কাছে আর কিছু জানবার নেই।’

দরজার দিকে ফিরিতেই দেখিলাম, চাঁদনী কখন পর্দার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার মুখে উদ্বেগ ও আশঙ্কার ব্যঞ্জনা। আমাদের দৃষ্টি তাহার উপর পাড়িতেই সে চকিতে সরিয়া গেল।

আমরা পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। রতিকান্ত পাণ্ডেজিকে নিম্নস্বরে প্রশ্ন করিল‌, ‘চাঁদনী দেবীকে সওয়াল করা হবে নাকি?’

পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের দিকে চাহিলেন। ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘পরে দেখা যাবে। এখন চলুন‌, শকুন্তলা দেবীর মহলে।’

দেবনারায়ণের মহল হইতে শকুন্তলার মহলে যাইবার পথে ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী হঠাৎ আমাদের নিকট বিদায় লইলেন। পুত্র লীলাধর সম্পর্কে তাঁহার মন বোধহয় বিক্ষিপ্ত হইয়াছিল‌, নহিলে এত সহজে আমাদের ছাড়িয়া যাইতেন না। বলিলেন‌, ‘আমার সন্ধ্যা আহিকের সময় হল‌, আমি এবার যাই। আপনারা কাজ করুন।’

তিনি সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন। আমরা শকুন্তলা দেবীর মহলে প্রবেশ করিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইতে আরম্ভ করিয়াছে‌, রতিকান্ত সুইচ টিপিয়া আলো জ্বলিতে জ্বলিতে আমাদের আগে আগে চলিল।

প্রথমে একটি মাঝারি গোছের ঘর। দেশী প্রথায় চৌকির উপর ফরাসের বিছানা‌, কয়েকটি গদি-মোড়া নীচু কেদারা‌, ঘরের কোণে উঁচু টিপাইয়ের মাথায় রূপার পাত্রে ফুল সাজানো। দেয়ালে যামিনী রায়ের আঁকা একটি ছবি। এখানে বাড়ির লোকেরা বসিয়া গল্প-গুজবে সন্ধ্যা কাটাইতে পারে‌, আবার অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধব আসিলেও বসানো যায়।

0 Shares