ঘরে কেহ নাই। আমরা এ-ঘর উত্তীর্ণ হইয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি বেশ বড় ঘর, দু’টি পালঙ্ক দু’পাশের দেয়ালে সংলগ্ন হইয়া আছে। একটি বড় ওআর্ডরোিব রহিয়াছে, একটি আয়না-দার টেবিলে কয়েকটি ওষুধের শিশি। মনে হয়। এটি দীপনারায়ণের শয়নকক্ষ ছিল। বর্তমানে শয্যা দু’টির উপর সুজনি ঢাকা রহিয়াছে। এ ঘরটিও শূন্য। ব্যোমকেশ মৃদুকণ্ঠে বলিল,–’এটি বোধ হচ্ছে দীপনারায়ণবাবুর শোবার ঘর ছিল। দুটো খাট কেন?
রতিকান্ত একটু ইতস্তত করিয়া বলিল-দীপনারায়ণজির অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছিল তখন একজন নার্স রাত্রে থাকত।’
‘ঠিক ঠিক, আমার বোঝা উচিত ছিল।’
অতঃপর আমরা তৃতীয় কক্ষে প্রবেশ করিলাম এবং চারিদিকে চাহিয়া চমৎকৃত হইয়া গেলাম। এ ঘরটি আরও বড় এবং নীলাভ নিওন-লাইট দ্বারা আলোকিত। পিছনের দিকের দেয়ালে সম-ব্যবধানে তিনটি জানালা, জানালার ব্যবধানস্থলে সুচিত্রিত মহার্ঘ মিশরী গালিচা বুলিতেছে। ঘরের এক পাশে একটি অগনি এবং তাহার আশেপাশে দেয়ালে টাঙানো নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র। ঘরের অপর পাশে ছবি আঁকার বিবিধ সরঞ্জাম, দেয়ালের গায়ে আঁকা একটি প্রশস্ত তৈলচিত্র। মেঝের উপর পুরু মখমলের আস্তরণ বিছানো, তাহার মাঝখানে গুরু নিতস্বিনী রাজকন্যার মত একটি তানপুরা শুইয়া আছে। বুঝিতে বিলম্ব হয় না। কলা-কুশলী শকুন্তলার এটি শিল্পনিকেতন। দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়। একই বাড়ির দুই অংশে রুচিনৈপুণ্য ও সৌন্দৰ্য-বোধের কতখানি তফাৎ, চোখে না দেখিলে বিশ্বাস হয় না।
ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রথমেই দেয়ালে আকা তৈলচিত্রটির প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল। সে কোনও দিকে না চাহিয়া ছবির সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। ছবিটির খাড়াই তিন ফুট, পাশাপাশি পাঁচ ফুট। বিষয়বস্তু নূতন নয়, বন্ধলধারিণী শকুন্তলা তরুআলবালে জল-সেচন করিতেছে এবং দুষ্মন্ত পিছনের একটি বৃক্ষকাণ্ডের আড়াল হইতে চুরি করিয়া শকুন্তলাকে দেখিতেছেন। ছবিখানির অঙ্কন-শৈলী ভাল, শকুন্তলার হাত পা খ্যাংরা কাটির মত নয়, দুষ্মন্তকে দেখিয়াও যাত্ৰাদলের দুঃশাসন বলিয়া ভ্বম হয় না। চিত্রের বাতাবরণ পুরাতন, কিন্তু মানুষ দু’টি সর্বকালের। ছবি দেখিয়া মন তৃপ্ত হয়।
ব্যোমকেশের দিকে চোখ ফিরাইয়া দেখিলাম। সে তন্ময় হইয়া ছবি দেখিতেছে। তাহার দেখাদেখি রতিকান্ত ও পাণ্ডেজি আমাদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ব্যোমকেশ তখন তাঁহাদের দিকে ফিরিয়া উৎসাহ ভরে বলিল, ‘চমৎকার ছবি। কে এঁকেছে?’
পাণ্ডেজি রতিকান্তের দিকে চাহিলেন, রতিকান্ত দ্বিধাভরে বলিল, ‘বোধহয় শকুন্তলা দেবীর আঁকা। ঠিক বলতে পারি না।’
ব্যোমকেশ আবার ছবির দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘তাই হবে। একালের শকুন্তলা সেকালের শকুন্তলার ছবি এঁকেছেন। দেখেছি অজিত, তপোবনকন্যা শকুন্তলার মুখে কী শান্ত সরলতা, দুষ্মস্তের চোখে কী মোহাচ্ছন্ন অনুরাগ, সহকার তরুগুলির কী সজীব শ্যামলতা। সব মিলিয়ে সংসার ও আশ্রমের একটি অপূর্ব সমন্বয় হয়েছে। —যদি সম্ভব হত ছবিটি তুলে নিয়ে যেতাম।’
একটু অবাক হইলাম। ব্যোমকেশের মনে শিল্পরস বোধ থাকিতে পারে। কিন্তু তাহা কোনও কালেই উচ্ছসিত হইয়া উঠিতে দেখি নাই। আমি চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহার পানে তাকাইয়া আছি দেখিয়া সে সামলাইয়া লইল; ছবির দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া ঘরের চারিদিকে চোখ কুলাইল। শকুন্তলা দেবীর বর্তমান অবস্থা স্মরণ করিয়া একটু ব্যথিত স্বরে বলিল, ‘এটা দেখছি শকুন্তলা দেবীর গান-বাজনা ছবি-আঁকার ঘর.সাজানো বাগান…ভুলে থাকার উপকরণ—’ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, চলুন।’
অতঃপর আমরা আরও একটা শূন্য ঘর এবং একটা বারান্দা পার হইয়া শকুন্তলার শয়নকক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। দরজা ভেজানো ছিল, রতিকান্ত টোকা দিলে একটি মধ্যবয়স্ক দাসী দ্বার খুলিয়া দিল। রতিকান্ত ঘরের ভিতর গলা বাড়াইয়া কুষ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘আমরা পুলিসের পক্ষ থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে এসেছি।’
কিছুক্ষণ পরে ঘরের ভিতর হইতে অস্ফুট আওয়াজ আসিল—’আসুন।’
আমরা সসঙ্কোচে ঘরে প্রবেশ করিলাম। রতিকান্ত দাসীকে মাথা নাড়িয়া ইঙ্গিত করিল, দাসী বাহিরে গেল।
শকুন্তলা দেবীর শয়নকক্ষের বর্ণনা দিব না। অনবদ্য রুচির সহিত অপরিমিত অর্থবল সংযুক্ত হইলে যাহা সৃষ্টি হয় এ ঘরটি তাহাই। শকুন্তলা পালঙ্কের উপর বসিয়া ছিলেন, আমরা প্রবেশ করিলে একটি ক্রীম রঙের কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়াইয়া লইলেন। কেবল তাঁহার মুখখানি খোলা রহিল। মোমের মত আচ্ছাভ বর্ণ, চোখের কোলে কালি পড়িয়াছে। চুলগুলি শিথিল ও অবিন্যস্ত। যেন হিম-ক্লিন্ন করা শেফালি।
‘বসুন-শকুন্তলা ক্লান্তি-বিনীত চক্ষু দু’টি একবার আমাদের পানে তুলিলেন।
ঘরে কয়েকটি চামড়ার গদি-মোড়া নীচু চৌকি ছিল, আমি ও ব্যোমকেশ দু’টি চৌকি খাটের কাছে টানিয়া লইয়া বসিলাম। রতিকান্ত ও পাণ্ডেজি খাটের বাজু ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
ব্যোমকেশ পাণ্ডেজির দিকে দৃষ্টি তুলিয়া নীরবে অনুমতি চাহিল, পাণ্ডেজি একটু ঘাড় নাড়িলেন। ব্যোমকেশ তখন অত্যন্ত মোলামেয় স্বরে শকুন্তলাকে বলিল, ‘আপনাকে এ সময়ে বিরক্ত করতে এসেছি, আমাদের ক্ষমা করবেন। মানুষের জীবনে কখন যে কী দুৰ্দৈব ঘটবে কেউ জানে না, তাই আগে থাকতে প্রস্তুত থাকবার উপায় নেই। আপনার স্বামীকে আমি একবার মাত্র দেখেছি, কিন্তু তিনি যে কি রকম সজ্জন ছিলেন তা জানতে বাকি নেই। তাঁর মৃত্যুর জন্যে যে দায়ী সে নিস্কৃতি পাবে না। এ আশ্বাস আপনাকে আমরা দিচ্ছি।’ শকুন্তলা উত্তর দিলেন না, কাতর চোখ দু’টি তুলিয়া নীরবে ব্যোমকেশকে ধন্যবাদ জানাইলেন।