ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাকে দুএকটা প্রশ্ন করব। নেহাত প্রয়োজন বলেই করব, আপনাকে উত্যক্ত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।–কিন্তু আসল প্রশ্ন করার আগে একটা অবান্তর কথা জেনে নিই, ও ঘরের দেয়ালে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার ছবিটি কি আপনার আঁকা?’
শকুন্তলার চোখে চকিত বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল, তিনি কেবল ঘাড় হেলাইয়া জানাইলেন-হ্যাঁ, ছবি তাঁহারই রচনা।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চমৎকার ছবি, আপনার সত্যিকার শিল্পপ্রতিভা আছে। কিন্তু ওকথা যাক। দীপনারায়ণবাবু উইল করে গেছেন। কিনা। আপনি জানেন?’
এবার শকুন্তলা অবুঝের মত চক্ষু তুলিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, তারপর স্তিমিত স্বরে বলিলেন, ‘এসব আমি কিছু জানি না। উনি আমার কাছে বিষয় সম্পত্তির কথা কখনও বলতেন না!’
‘আপনার নিজস্ব কোনও সম্পত্তি আছে কি?’
‘তাও জানি না। তবে–’
‘তবে কি?’
‘বিয়ের পর আমার স্বামী আমার নামে পাঁচ লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছিলেন।’
‘তাই নাকি! সে টাকা এখন কোথায়?’
‘ব্যাঙ্কেই আছে। আমি কোনও দিন সে টাকায় হাত দিইনি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল।
‘তাহলে এই পাঁচ লাখ টাকা আপনার নিজস্ব স্ত্রীধন। তারপর যদি আপনার পুত্রসন্তান জন্মায় তাহলে সে এজমালি সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ পাবে।’
শকুন্তলা চোখ তুলিলেন না, নতনেত্রে রহিলেন। মনে হইল তাঁহার মুখখানা আরও পাণ্ডুর রক্তহীন হইয়া গিয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভাল কথা, আপনি যে সন্তান-সম্ভব একথা আপনার স্বামী জানতেন?’
নতনয়না শকুন্তলার ঠোঁট দু’টি একটু নড়িল, ‘জানতেন। কাল রাত্রে তাঁকে বলেছিলাম।’
‘কাল রাত্রে। খাওয়া-দাওয়ার আগে, না পরে?’
‘পরে। উনি তখন শুয়ে পড়েছিলেন।’
‘খবর শুনে উনি নিশ্চয় খুব খুশি হয়েছিলেন।’
‘খুব খুশি হয়েছিলেন, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন–’
এই পর্যন্ত বলিয়া শকুন্তলার ভাব হঠাৎ পরিবর্তিত হইল। এতক্ষণ তিনি ক্লান্ত ত্ৰিয়মাণাভাবে কথা বলিতেছিলেন, এখন ভয়ার্ত বিহ্বলতায় একে একে আমাদের মুখের পানে চাহিলেন, তারপর একটি অবরুদ্ধ কাতরোক্তি করিয়া মুৰ্ছিত হইয়া পড়িলেন।
আমরা ক্ষণকালের জন্য বিমূঢ় হইয়া গেলাম। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই, দ্বারের কাছে চাঁদনী কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। এখন সে ছুটিয়া আসিয়া শকুন্তলার মাথা কোলে লইয়া বসিল, আমাদের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘আপনারা কি রকম মানুষ, মেরে ফেলতে চান ওঁকে? যান, শীগগির যান এ ঘর থেকে। শরীরে একটু দয়ামায়া কি নেই। আপনাদের? এখুনি মিস মান্নাকে খবর পাঠান।’
আমরা পালাইবার পথ পাইলাম না। নীচে নামিতে নামিতে শুনিতে পাইলাম চাঁদনী উচ্চকণ্ঠে দাসীকে ডাকিতেছে—’সোমরিয়া, কোথায় গেলি তুই-শীগগির জল আন—‘
নীচে নামিয়া পাণ্ডেজি প্রথমেই মিস মান্নাকে টেলিফোন করিলেন—’শীগগির চলে আসুন, আপনি না। আসা পর্যন্ত আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।’
তারপর আমরা হল-ঘরে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। রাত্রি হইয়া গিয়াছে, ঘড়িতে সাতটা বাজিয়া গেল।
পাণ্ডেজি বিললেন, ‘রতিকান্ত, দেখে এস শকুন্তলা দেবীর জ্ঞান হল কিনা।’
রতিকান্ত চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ বিমর্ষ মুখে বসিয়াছিল, চোখ তুলিয়া বলিল, ‘পাণ্ডেজি, মিস মান্নাকে এখন কিছুদিন শকুন্তলা দেবীর কাছে রাখা দরকার, তার ব্যবস্থা করুন। তিনি সর্বদা শকুন্তলার কাছে থাকবেন, একদণ্ডও তাঁর কাছ-ছাড়া হবেন না।’
‘বেশ।’
ম্যানেজার গঙ্গাধর এই সময় ফিরিয়া আসিলেন এবং শকুন্তলার মুছার কথা শুনিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিলেন। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘মিস মান্নাকে এখানে কিছুদিন রাখার ব্যবস্থা করুন। শকুন্তলা দেবী অন্তঃসত্ত্বা্্, তার ওপর এই দুৰ্দৈব। ওঁর কাছে অষ্টপ্রহর ডাক্তার থাকা দরকার।’
ম্যানেজারের মুখখানা কেমন একরকম হইয়া গেল। তারপর তিনি সামলাইয়া লইয়া বলিলেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়।’
মিস মান্না আসিলেন, হাতে ওষুধের ব্যাগ। তাঁহাকে সংক্ষেপে সব কথা বলা হইলে তিনি বলিলেন, ‘বেশ, আমি থাকব। আমার কিছু জিনিসপত্র আনিয়ে নিলেই হবে।’
তিনি দ্রুতপদে উপরে চলিয়া গেলেন।
দশ মিনিট পরে রতিকান্ত নামিয়া আসিয়া বলিল, ‘জ্ঞান হয়েছে। ডাক্তার মান্না বললেন ভয়ের কোনও কারণ নেই।’
পাণ্ডেজি গাত্ৰোত্থান করিলেন।
‘আমরা এখন উঠলাম। রতিকান্ত, তুমি এখানকার কাজ সেরে একবার আমার বাসায় যেও।’ আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, চলুন, আমার ওখানে চা খাবেন।’
৯
মোটরে যাইতে যাইতে শকুন্তলার শয়নকক্ষের দৃশ্যটাই চোখের সামনে ভাসিতে লাগিল। মনে হইল যেন একটি মর্মস্পশী নাটকের নিগূঢ় দৃশ্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করিলাম। শকুন্তলা যদি মূৰ্ছিত হইয়া না পড়িতেন এবং চাঁদনী আসিয়া যদি রাসভঙ্গ না করিত–
শকুন্তলা হঠাৎ মূৰ্ছিত হইলেন কেন? অবশ্য এরূপ অবস্থায় যে-কোনও মুহুর্তে মুছাঁ যাওয়া বিচিত্র নয়, তবু শোকের প্রাবল্যই কি তাহার একমাত্র কারণ?
ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম। সে চিন্তার অতলে তলাইয়া গিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শকুন্তলার মূছাঁর কথা ভাবিছ নাকি?’
সে সচেতন হইয়া বলিল, ‘মুর্ছা! না–আমি ভাবছিলাম ডাক-বাক্সর কথা।’
অবাক হইয়া বলিলাম, ‘ডাক-বোক্সর কথা ভাবছিলে?’
সে বলিল, ‘হ্যাঁ, দীপনারায়ণের বাড়ির কোণে যে ডাক-বাক্স আছে তারই কথা। ভারি লাগসৈ জায়গায় সেটা আছে। দেখলে মনে হয় লাল কুতা-পরা গোলগাল একটি সেপাই রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়।’