বহ্নি-পতঙ্গ

‘আসলে তবে কি?’

‘আসলে শ্রীরাধিকার দূতী।’

‘বুঝলাম না। ব্যাসকুট ছেড়ে সিধে কথা বল।’

ব্যোমকেশ কিন্তু সিধা কথা বলিল না‌, মুখে একটা একপেশে হাসি আনিয়া কতকটা নিজ মনেই বলিল, ‘অভিসারের আইডিয়াটি ভারি মিষ্টি, অবশ্য যদি অভিসারিকা পরস্ত্রী হয়। নিজের স্ত্রী অভিসার করলে বোধহয় তত মিষ্টি লাগে না।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ ‘রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম।’

‘কি আবোল-তাবোল বকছ!’

ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে বলিল‌, ‘আবোল-তাবোল নয়‌, এটা গীতগোবিন্দ। যদি আবোল-তাবোল শুনতে চাও শোনাতে পারি‌, ছন্দ একই। বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে—‘

পাণ্ডেজি মোটর চালাইতে চালাইতে হাসিয়া উঠিলেন। আমি হতাশ হইয়া। আপাতত আমার কৌতুহল সম্বরণ করিলাম।

পাণ্ডেজির বাসায় পৌঁছিয়া দেখা গেল চা প্রস্তুত। তার সঙ্গে গরম গরম বেগুনি‌, পকৌড়ি‌, ডালের ঝালবড়া। ব্যোমকেশ দ্বিরুক্তি না করিয়া বসিয়া গেল। আমরাও যোগ দিলাম।

বেশ খানিকটা রসদ আত্মসাৎ করিবার পর ব্যোমকেশ তৃপ্তস্বরে বলিল‌, ‘এতক্ষণ বুঝতে পারিনি‌, আমার অন্তরাত্মা এই জিনিসগুলির পথ চেয়ে ছিল।’

পাণ্ডেজি হাসিয়া বলিলেন‌, ‘এখন তো পথ চাওয়া শেষ হল‌, এবার বলুন কি দেখলেন শুনলেন।’

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় লম্বা একটি চুমুক দিয়া সযত্নে পেয়ালা নামাইয়া রাখিল‌, গড়গড়ার নলে কয়েকটা বুনিয়াদি টান দিল‌, তারপর চিন্তা-মন্থর কণ্ঠে বলিল‌, ‘দেখলাম শুনলাম অনেক কিছু‌, কিন্তু এখনও শেষ দেখা যাচ্ছে না।’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘তবু? ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দুটো মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে। এক-টাকা‌, দুই—ম্মরগরল। কোনদিকের পাল্লা ভারী এখনও বুঝতে পারছি না। হতে পারে‌, দুটো মোটিভ জড়াজড়ি হয়ে গেছে।’

আমি বলিলাম‌, ‘মোটিভ যেমনই হোক‌, লোকটা কে?’

ব্যোমকেশ একটু অধীরভাবে বলিল‌, ‘তা কি করে বলব? যে-ব্যক্তি ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়েছিল সে ভাড়াটে লোক হতে পারে। যে তাকে নিয়োগ করেছিল তাকেই আমরা খুঁজছি।’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘আমরা যাদের চিনি তাদের মধ্যে এমন কে আছে যে নিয়োগ করতে পারে। এক আছে দেবনারায়ণ। কিন্তু সে কি–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ‌, প্রথমে দেবনারায়ণকে ধরুন। দেবারায়ণকে দেখলে মনে হয় নিরেট আহাম্মক; কিন্তু এটা তার ছদ্মবেশ হতে পারে। সেই হয়তো লোক লাগিয়ে খুড়োকে মেরেছে। তার আজ্ঞাবহ মোসাহেবের অভাব নেই‌, লীলাধর বংশী বা বেণীপ্রসাদ যে-কেউ পুরস্কারের আশ্বাস পেলে খুন করবে। এখানে মোটিভ হল‌, সম্পত্তির একাধিপত্য।’

আমি বলিলাম‌, ‘কিন্তু—‘

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া আমাকে নিবারণ করিল–’তারপর ধরা যাক-চাঁদনী।’

‘চাঁদনী!’

‘হ্যাঁ‌, চাঁদনী। শকুন্তলার প্রতি তার এত দরদ স্বাভাবিক মনে হয় না‌, যেন একটু বাড়াবাড়ি। সে হয়তো মনে মনে তাঁকে হিংসে করে‌, তাঁর প্রাধান্য খর্ব করতে চায়। দীপনারায়ণের মৃত্যুর পর শকুন্তলা আর সংসারের কত্রী থাকবেন না‌, কত্রী হবে চাঁদনী। দেবনারায়ণ যদি সত্যি সত্যিই ন্যালা-ক্যাবলা হয়‌, সে চাঁদনীর মুঠোর মধ্যে থাকবে‌, চাঁদনী হবে বিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র অধীশ্বরী–‘

‘কিন্তু–’

ব্যোমকেশ আবার হাত তুলিয়া আমাকে নিবৃত্ত করিল।

‘তারপর ধরুন-ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী। ডাক্তার পালিতের মতে ইনি গভীর জলের মাছ। সেটা এমন কিছু আশ্চর্য নয়‌, গভীর জলের মাছ না হলে এতবড় স্টেটের ম্যানেজার হওয়া যায় না। কিন্তু উনি যদি কুমীর হন তবেই ভাবনার কথা। ভেবে দেখুন। দীপনারায়ণ সিং বুদ্ধিমান লোক ছিলেন‌, বিষয় সম্পত্তির ওপর নজর রাখতেন। তিনি বেঁচে থাকতে পুকুর চুরি সম্ভব নয়‌, অল্পসল্প চুরি হয়তো চলে। কিন্তু তিনি যদি মারা যান তাহলে সমস্ত সম্পত্তি অশাবে দেবানারায়ণকে। তখন দুহাতে চুরি করা চলবে। সুতরাং ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীরও মোটিভ স্বীকার করতে হবে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গড়গড়া টানিল‌, আমরা নীরব রহিলাম। তারপর সে গড়গড়ার নল আমার হাতে দিয়া বলিল, ‘সর্বশেষে ধরুন—শকুন্তলা দেবী।‘

এইটুকু বলিয়া সে চুপ করিল। আমরা প্রতীক্ষ্ণ করিয়া রহিলাম। সে একবার নড়িয়া চড়িয়া বসিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘কোনও মহিলার চরিত্র নিয়ে আলোচনা করা ভদ্রলোকের কাজ নয়‌, কিন্তু যেখানে একটা খুন হয়ে গেছে‌, সেখানে আলোচনা না করেও উপায়। নেই। শকুন্তলা দেবী তিন মাস অন্তঃস্বত্ত্বা, অথচ তিন মাস আগে দীপনারায়ণ সিং শয্যাগত ছিলেন‌, সে সময়ে তাঁর দীর্ঘ রোগের একটা ক্রাইসিস যাচ্ছিল। …শকুন্তলা আজ আমাদের বললেন‌, কাল রাত্রে তিনি স্বামীকে সন্তান সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন‌, শুনে দীপনারায়ণ সিং আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। … কথাটা বোধহয় সত্যি নয়।’

প্রশ্ন করিলাম‌, ‘সত্যি নয় কেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দীপনারায়ণ সিং যদি আনন্দে আত্মহারা হয়েই পড়েছিলেন তবে এই মহা আনন্দের সংবাদ কাউকে দিলেন না কেন? রাত্রে না হোক‌, সকালবেলা ডাক্তার পালিতকে তো বলতে পারতেন‌, শুভসংবাদ পাকা কিনা জািনবার জন্য মিস মান্নাকে ডাকতে পারতেন। …শকুন্তলা স্বামীকে বলেননি‌, কারণ স্বামীকে বলবার মত কথা নয়। দীপনারায়ণ সিং জানতে পারলে শকুন্তলাকে খুন করতেন‌, নচেৎ বাড়ি থেকে দূর করে দিতেন। তাই জানাজানি হবার আগেই দীপনারায়ণ সিংকে সরানো দরকার হয়েছিল।’

বলিলাম‌, কিন্তু ধরো‌, ডাক্তার পালিত যদি ভুল করে থাকেন?’

ব্যোমকেশ শুষ্ক স্বরে বলিল‌, ‘ডাক্তার পালিত এবং মিস মান্না দু’জনেই যদি ভুল করে থাকেন‌, যদি শকুন্তলা নিষ্কলঙ্ক হন‌, তাহলে দীপনারায়ণকে খুন করার তাঁর কোনও মোটিভ নেই। কিন্তু ডাক্তার পালিত বা মিস মান্না দায়িত্বহীন ছেলেমানুষ নয়‌, তাঁরা ভুল করেননি। ইচ্ছে করেও মিছে কথাও বলেননি‌, যে মিছে কথা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবে তেমন মিথ্যে কথা বলবার লোক ওঁরা নন।‘

0 Shares