বহ্নি-পতঙ্গ

বলিলাম‌, ‘আমি ওকথা বলছি না। শকুন্তলা যে অন্তঃস্বত্ত্বা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু দীপনারায়ণ যে–’

‘তুমি যা বলতে চাও আমি বুঝেছি। কিন্তু সে দিকেও বাড়িসুদ্ধ লোক সাক্ষী আছে‌, ডাক্তার পালিত মিছে কথা বলে পোর পাবেন না।’ ব্যোমকেশ আমার হাত হইতে গড়গড়ার নল লইয়। আবার টানিতে লাগিল।

আমি বলিলাম‌, ‘বেশ‌, তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক যে শকুন্তলার একটি দুষ্মন্ত আছে। কিন্তু সে লোকটা কে?’

ব্যোমকেশ একটু চকিতভাবে আমার পানে চাহিল‌, অর্ধব্যক্ত স্বরে বলিল‌, ‘শকুন্তলার দুষ্মন্ত! বেশ বলেছ। —ওই দুষ্মন্তকেই আমরা খুঁজছি। ডাক্তার পালিতের ব্যাগে যে ওষুধের বদলে বিষ রেখে গিয়েছিল সে ওই দুষ্মন্ত ছাড়া আর কে হতে পারে?’

‘দুষ্মন্তটি তবে কে?’

‘সেটা শকুন্তলার রুচির ওপর নির্ভর করে। তিনি মার্জিত রুচির আধুনিক মহিলা‌, সুতরাং দুষ্মন্তও আধুনিক শিক্ষিত লোক হওয়া সম্ভব। নর্মদাশঙ্কর বা তাদের দলের কেউ হতে পারে। আবার এমন লোক হতে পারে যার প্রকাশ্যভাবে ও বাড়িতে যাতায়াত নেই।’

পাণ্ডেজি কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন‌, বলিলেন‌, ‘কিম্বা মনে করুন‌, যদি এমন কেউ হয় যে শকুন্তলাকে বিপদে ফেলে সরে পড়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দুষ্মন্তদের পক্ষে সেটা খুবই স্বাভাবিক। তখন শকুন্তলাকে অন্য চেষ্টা করতে হবে‌, অর্থাৎ অন্য সহকারী যোগাড় করতে হবে।’

‘সে-রকম সহকারী তিনি পাবেন কোথায়?’

‘কেন সহকারীর অভাব কিসের? স্বয়ং গঙ্গাধর বংশী রয়েছেন‌, তস্য পুত্ব লীলাধর আছে‌, বেণীপ্রসাদ আছে‌, উপযুক্ত দক্ষিণা পেলে সকলেই রাজী হবে। এমন কি ডাক্তার পালিত আর মিস মান্নাকেও বাদ দেওয়া যায় না। ঠিক বাছতে গাঁ উজোড়।’ আমরা নিবাক হইয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের গড়গড়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই। তারপর সে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলিল‌, ‘দেয়ালে আঁকা ছবিটার কথা বার বার মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে‌, ওটা শুধু ছবি নয়‌, ওর মধ্যে শিল্পীর অন্তরতম কথাটি লুকিয়ে আছে। ছবিটি দিনের আলোয় আর একবার ভাল করে দেখতে হবে।’

ভৃত্য আসিয়া জানাইল‌, ইন্সপেক্টর চৌধুরী আসিয়াছেন।

১০

রতিকান্ত ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল‌, ‘এই মাত্র কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট দিয়ে গেল। ওষুধে বিষ পাওয়া যায়নি।’

আমরা হয় করিয়া চাহিয়া রহিলাম। লিভারের ভায়ালে কিউরারি পাওয়া যাইবে এ বিষয়ে আমরা এতাই নিশ্চিন্তু ছিলাম যে কথাটা হঠাৎ বোধগম্য হইল না।

‘বিষ পাওয়া যায়নি?’

‘না। এই দেখুন রিপোর্ট।’ রতিকান্ত ব্যোমকেশের হাতে এক টুকরা কাগজ দিল।

রিপোর্টে কোন বিষের নামগন্ধ নাই‌, নিতান্ত সহজ স্বাভাবিক লিভারের আরক। ব্যোমকেশ কুঞ্চিতচক্ষে পাণ্ডেজি ও রতিকান্তের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।

‘ভারি আশ্চর্য।’

রতিকান্ত একবার গলা ঝাড়া দিয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, এ থেকে আপনার কি মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আগে আপনি বলুন আপনার কি মনে হয়?’

বোধ হইল রতিকান্ত মনে মনে খুশি হইয়াছে। সে একটি চেয়ারের কিনারায় বসিল‌, কিছুক্ষণ একাগ্রভাবে একদিকে চাহিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল, ‘দীপনারায়ণজি কিউরারি বিষে মারা গেছেন তাতে সন্দেহ নেই। পোস্ট-মর্টেমে বিষ পাওয়া গেছে। তাঁর শরীরে বিষ প্রবেশ করল। কি করে? ইনজেকশন ছাড়া অন্য উপায়ে প্রবেশ করতে পারে না। অথচ যে ভায়াল থেকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল তাতে বিষ পাওয়া গেল না–’ রীতিকান্ত একটু ইতস্তত করিল–’এ থেকে একমাত্র অনুমান করা যায়‌, ডাক্তার পালিত যে ভায়াল থেকে ইনজেকশন দিয়েছিলেন সে ভায়াল আমাদের দেননি‌, অন্য ভায়াল দিয়েছিলেন।’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘কিন্তু কেন? তাতে ওঁর লাভ কি?’

রতিকান্ত একটু উদ্বিগ্নভাবে বলিল‌, ‘লাভ এই হতে পারে যে‌, আমরা মনে করব ইনজেকশনের জন্য মৃত্যু হয়নি।’

‘ডাক্তার ছাড়া আর কেউ হতে পারে না কি? দীপনারায়ণের মৃত্যুর পর ঘরে অনেক লোক এসেছিল‌, গোলমালের মধ্যে হয়তো কেউ ভায়ালটা সরিয়েছে।’

‘অসম্ভব নয়‌, কিন্তু–’

ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল‌, ‘আপনি মনে করেন ডাক্তার পালিতাই প্রকৃত অপরাধী?

রতিকান্ত একটু চুপ করিয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আজ থানায় আপনি ডাক্তার পালিত সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত করলেন সেটা আমার মাথায় ঘুরছিল‌, তারপর অ্যানালিসিসের রিপোর্ট পেয়ে মনে হল ডাক্তার পালিত যদি নির্দোষ হন তবে সিধা পথে চলছেন না কেন? এ অবস্থায় তাঁর ওপর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। অবশ্য দীপনারায়ণজির মৃত্যুতে ওঁর ব্যক্তিগত কোনও লাভ নেই। কিন্তু যাদের লাভ আছে তারা ওঁকে টাকা খাইয়ে নিজেদের কাজ উদ্ধার করিয়ে নিতে পারে। হয়তো ওঁকে পঞ্চাশ হাজার কি এক লাখ টাকা খাইয়েছে। টাকার জন্যে মানুষ কি না করে।’

ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িল‌, ‘ঠিক কথা‌, টাকার জন্যে মানুষ কি না করে। ডাক্তার পালিত যদি টাকা খেয়ে একাজ করে থাকেন তাহলে শুধু ডাক্তার পালিতকে ধরলেই চলবে না‌, যে টাকা খাইয়েছে তাকেও ধরতে হবে। কে তাঁকে টাকা খাইয়েছে আপনি কিছু আন্দাজ করেছেন?’

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় দেবানারায়ণ ছাড়া আর কে হতে পারে।’

‘আপাতত তাই মনে হয় বটে‌, কিন্তু প্রমাণ কৈ? প্রমাণ কিছু পাওয়া গেছে কি?’

‘প্রমাণ এখনও কিছু পাওয়া যায়নি।’

রতিকান্ত পাণ্ডেজির দিকে তাকাইয়া বলিল‌, ‘আজ রাত্রি একটার ট্রেনে আমি বক্সার যাচ্ছি। কয়েদীটোকে জেরা করে যদি জানতে পারা যায় যে ডাক্তার পালিত কিউরারি কিনেছেন—’

0 Shares