পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘তাহলে অনেকটা সুরাহা হতে পারে। তুমি ফিরবে। কবে?’
‘কাল সন্ধ্যে নাগাদ ফিরতে পারব বোধহয়।–সাব-ইন্সপেক্টর তিওয়ারীকে থানার চার্জে রেখে যাচ্ছি।’
‘বেশ।–এদিকের কি ব্যবস্থা করলে?’
‘দীপনারায়ণজির বাড়িতে একজন হেড কনস্টেবলের অধীনে চারজন কনস্টেবল বসিয়ে যাচ্ছি, তারা চব্বিশ ঘণ্টা পাহারায় থাকবে। আপনি তো মিস মান্নাকে শকুন্তলা দেবীর কাছে রাত্রে থাকতে বলে এসেছেন।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘হ্যাঁ, মিস মান্না এখন কিছুদিন শকুন্তলার কাছেই থাকবেন। তুমি তো শুনেছি শকুন্তলা অন্তঃস্বত্ত্বা।’
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া রতিকান্ত ঈষৎ গাঢ়স্বরে বলিল, ‘শুনেছি। দীপনারায়ণজি সন্তানের জন্যে বড় ব্যাকুল হয়েছিলেন। তিনি দেখে যেতে পেলেন না।’
ঘড়িতে ঠং ঠেং করিয়া আটটা বাজিল। রতিকান্ত উঠিয়া পড়িল, ‘যাই, আমাকে আবার তৈরি হতে হবে। আপনারা এদিকে একটু নজর রাখবেন।’ হাসিমুখে স্যালুট করিয়া রতিকান্ত চলিয়া গেল।
দেখিলাম রতিকান্তের ব্যবহার এবেলা অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক হইয়াছে। সে প্রথমটা একটু আড়ষ্ট হইয়াছিল। তাহার এলাকার মধ্যে ব্যোমকেশের আবির্ভাব মনে মনে পছন্দ করে নাই; এখন বোধহয় সে বুঝিয়াছে ব্যোমকেশ তাহার কৃতিত্বে ভাগ বসাইতে চায় না, তাই নিশ্চিন্ত হইয়াছে।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চক্ষু মুদিয়া বসিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার পালিতের ব্যবহারে সঙ্গতি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, মৃত্যুর কারণ কিউরারি এবং তাঁর ইনজেকশনের ফলেই মৃত্যু হয়েছে। তবে আবার তিনি ওষুধের ভয়াল বদলে দিলেন কেন? ব্যোমকেশ আবার চক্ষু মুদিত করিল।
বাহিরে মোটরের শব্দ, হইল। ভূত্য আসিয়া বলিল, ডাক্তার পালিত আসিয়াছেন। ব্যোমকেশের চট্ করিয়া সমাধিভঙ্গ হইল, সে মৃদুকণ্ঠে পাণ্ডেজিকে বলিল, ‘ডাক্তারকে এসব বলে কোজ নেই।’
ডাক্তার পালিত আসিলে পাণ্ডেজি তাঁহাকে সমুচিত শিষ্টতা সহকারে বসাইলেন।
ডাক্তার ক্লান্তভাবে বলিলেন, ‘প্রাণে শান্তি নেই, পাণ্ডেজি। ডিসপেনসারি বন্ধ করবার পর ভাবলাম খোঁজ নিয়ে যাই যদি কিছু খবর থাকে।’
পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের পানে কটাক্ষপাত করিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘খবর তো আমরাও খুঁজে বেড়াচ্ছি, ডাক্তারবাবু্, কিন্তু পাচ্ছি কৈ? আপনি শকুন্তলা দেবী সম্বন্ধে যে-সব কথা বলেছিলেন তা যদি সত্য হয়—‘
ডাক্তারের মুখ একটু অপ্রসন্ন হইল, ‘সত্যি কিনা অন্য যে-কোেনও ডাক্তার শকুন্তলাকে পরীক্ষা করলেই জানতে পারবেন।’
ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি বলিল, ‘না না, সেকথা আমি বলছি না, সেকথা শকুন্তলা নিজেই স্বীকার করেছেন। আমরা ভাবছি দীপনারায়ণ সিং সে সময়ে মরণাপন্ন ছিলেন–’
ডাক্তার বলিলেন, ‘তারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তিন মাস আগে দীপনারায়ণ সিং-এর অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল, শহরের অনেক ডাক্তার তাঁকে দেখেছিলেন, তাঁরা বলতে পারবেন। তাছাড়া একজন নার্স তখন অষ্টপ্রহর তাঁর কাছে থাকত। সে বলতে পারবে।’
‘তাই নাকি! কি নাম নার্সের?’
‘মিস ল্যাম্বার্ট। মেডিকেল কলেজের কাছে থাকে।’
ব্যোমকেশ পাণ্ডেজিকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি চেনেন?’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘চিনি না, কিন্তু বাসাটা দেখেছি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বসিয়া বসিয়া কি ভাবিল, তারপর ডাক্তার পালিতের দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘ডাক্তারবাবু্, এবার আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবেন না। আপনি দীপনারায়ণ সিং-এর স্টেট থেকে বারো হাজার টাকা ধার নিয়েছেন কেন?
ডাক্তার পালিত আকাশ হইতে পড়িলেন, চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিলেন, ‘টাকা ধার নিয়েছি।! সে কি, কে বললে আপনাকে?’
‘ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশীর মুখে শুনলাম। তবে কি একথা সত্যি নয়?’
‘সর্বৈব মিথ্যে। বারো হাজার টাকা! গঙ্গাধর বংশী তো দেখছি সাংঘাতিক লোক। দীপনারায়ণবাবু মারা গেছেন এই ফাঁকে বারো হাজার টাকা হজম করতে চায়। দাঁড়ান ব্যাটাকে আমি দেখাচ্ছি, এখনি গিয়ে টুটি টিপে ধরব। আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেবে, এত বড় আস্পর্ধা।’
ডাক্তার পালিত উঠিবার উপক্রম করিতেই ব্যোমকেশ বলিল, ‘বসুন, বসুন, ম্যানেজারের সঙ্গে বোঝাপড়া পরে করবেন।–কিন্তু কিছু সত্যি যদি না থাকে একথা উঠলো কি করে?’
ডাক্তার একটু চিস্তা করিয়া বলিলেন, ‘কি করে উঠলো তা বুঝতে পেরেছি। হাপ্ত দুই আগে একদিন সকালে দীপনারায়ণবাবুকে ইনজেকশন দিতে গেছি, তিনি আমার মোটর দেখে বললেন-ডাক্তার, তোমার গাড়িটা ঝড়ঝড়ে হয়ে গেছে, ওটা বদলে ফ্যালো। আমি বললাম, আজকাল নতুন গাড়ি কিনতে গেলে দশ-বারো হাজার টাকা খরচ, অত টাকা আমি কোথায় পাব! আমি এক পয়সা বাঁচাতে পারিনি, যা রোজগার করি সব খেয়ে ফেলি। শূনে তিনি আর কিছু বললেন না, একটু হাসলেন। আমার বিশ্বাস তিনি ওই টাকাটা আমায় দেবেন ঠিক করেছিলেন, হয়তো ম্যানেজারকে বলেও ছিলেন। তারপর তিনি যখন হঠাৎ মারা গেলেন তখন ম্যানেজারের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, বারো হাজার টাকা পকেটস্থ করার এই সুযোগ। দাঁড়ান না। আমি ওর ভুতুড়ি বার করে ছেড়ে দেব, আমার সঙ্গে চালাকি।’
ডাক্তার পালিত শাস্তশিষ্ট গভীর প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু দেখিলাম। তিনি চটিয়া আগুন হইয়া গিয়াছেন। তাঁহাকে আর বেশিক্ষণ ধরিয়া রাখা গেল না; তিনি উঠিয়া পড়িলেন এবং আজ রাত্রেই একটা হেস্তনেস্ত করিবেন বলিয়া প্রস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ কান পাতিয়া শুনিল, ডাক্তার পালিতের মোটর চলিয়া গেল। তখন সে লাফাইয়া উঠিয়া পাণ্ডেজিকে বলিল, চলুন, এখনি মিস ল্যাম্বার্টের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’