পাণ্ডেজি খামখানা খুলিতে খুলিতে বলিলেন, ‘কিন্তু দীপনারায়ণ সিং-এর নেমন্তন্ন চিঠি তুমি নিয়ে এলে যে?’
রতিকান্ত কৌতুকচ্ছলে মুখ কাঁচুমাচু করিয়া বলিল, কি করি স্যার, বড়মানুষ কুটুম্ব, কোনদিন মিনিস্টার হয়ে যাবেন, তাই খাতির রাখতে হয়। মাঝে মাঝে যাই সেলাম বাজাতে। আজ গিয়েছিলাম, তা পুলিস অফিসারদের নেমন্তন্ন চিঠিগুলো আমাকেই বিলি করতে দিলেন।’
পাণ্ডেজি খাম হইতে সোনালী জলে ছাপা তকতকে কার্ড বাহির করিয়া পড়িলেন, বলিলেন, ‘হুঁ, গুরুতর ব্যাপার দেখছি। রীতিমত ডিনার।–কিন্তু উপলক্ষটা কি?’
রতিকান্ত বলিল, ‘অনেকদিন রোগভোগ করে সেরে উঠেছেন তাই বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াচ্ছেন। শহরের গণ্যমান্য সকলকেই নেমন্তন্ন করেছেন।’
পাণ্ডেজি কার্ডাখানা আবার খামে পুরিতে পুরিতে বলিলেন, ‘কাল রাত্তিরে নেমন্তন্ন। কিন্তু আমি তো যেতে পারব না, রতিকান্ত।’
‘কোন স্যার, কাল কি আপনি ইনসাপেকশনে বেরুচ্ছেন?’
‘না। আমার এই বন্ধুদু’টি কলকাতা থেকে এসেছেন, কাল রাত্তিরে ওঁদের খেতে বলেছি।’
ব্যোমকেশ মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘মুগীর কাশ্মীরী কোর্মা।’
রতিকান্ত চকিত হাস্যে আমাদের পানে চাহিল। এতক্ষণ সে থাকিয়া থাকিয়া আমাদের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছিল; আমরা তাহার অপরিচিত অথচ পাণ্ডেজির সহিত বসিয়া গড়গড়া টানিতেছি দেখিয়া বোধহয় কৌতুহলী হইয়াছিল, কিন্তু কৌতুহল প্রকাশ করে নাই। এখন হাসিমুখে ডান হাতখানা কপালের কাছে লইয়া গিয়া স্যালুট করিল। তারপর পাণ্ডেজিকে বলিল, ‘হুজুর, কাশ্মীরী কোমার খবর আগে জানলে আমিও কাল এসে আপনার বাড়িতে আড্ডা গাড়তাম। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। আচ্ছা, আজ চলি।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘বোসো, চা খেয়ে যাও।’
রতিকান্ত বলিল, ‘চা আর একদিন হবে হুজুর। আর, যদি কাশ্মীরী কোমা খাওয়ান তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু আজ আর বসতে পারব না। এখনও দু’তিনখানা চিঠি বিলি করতে বাকি আছে। তাছাড়া দীপনারায়ণজিকে গিয়ে রিপোর্ট দিতে হবে। নিমন্ত্রণাপত্রে আর এস ভি পি লেখা আছে দেখেছেন তো।’
‘আচ্ছা, তাহলে এস।’
রতিকান্ত স্মিতমুখে আমাদের সকলকে একসঙ্গে স্যালুট করিয়া চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, ‘বাঃ, খাসা চেহারা ছোকরার! যেন রাজপুতুর!’
পাণ্ডেজি কহিলেন, ‘নেহাৎ মিথ্যে বলেননি। ওর পূর্বপুরুষেরা প্রতাপগড়ের মস্ত তালুকদার ছিল। প্রায় রাজারাজড়ার সামিল। এখন অবস্থা একেবারে পড়ে গেছে, তাই রতিকান্তকে চাকরি নিতে হয়েছে। ভারি বুদ্ধিমান ছেলে; নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছে, বি. এস-সি পাস করেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজকাল বড় ঘরের ছেলেরা পুলিসে ঢুকছে এটা সুলক্ষণ বলতে হবে।’ মুসলি। কিছুক্ষণ অন্যান্য প্রসঙ্গ আলোচনার পর ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, দীপনারায়ণ সিং কে?’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘দীপনারায়ণ সিং-এর নাম শোনেননি? বিহারের একজন প্রচণ্ড জমিদার, সালিয়ানা আয় দশ লাখ টাকা, তার ওপর তেজারাতির কারবার আছে। লোকটি কিন্তু ভাল। রাজনৈতিক আন্দোলনে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। এখন বয়স হয়েছে, পঞ্চাশের কাছাকাছি—‘ গড়গড়ায় কয়েকটি টান দিয়া বলিলেন, ‘বুড়ো বয়সে একটি ভুল করে ফেলেছেন তরুণী ভার্যা গ্বহণ করেছেন।’
‘সাবেক গৃহিণী বিদ্যমান?’
‘না, অতটা নয়। সাবেক গৃহিণী বছর কয়েক হল গত হয়েছেন, তারপর তরুণী ভাষাটি এসেছেন। ভদ্রলোককে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না, ছেলেপুলে নেই, এক ভাইপো আছে জমিদারীর শরিক, কিন্তু সেটা ঘোর অপদার্থ। এই রাজ-ঐশ্বৰ্য ভোগ করবার একটা লোক চাই তো।
‘তাহলে দীপনারায়ণ সিং আবার বিয়ে করে ভুলটা কী করেছেন? বংশরক্ষা তো হবে।’
বিংশ রক্ষা এখনও হয়নি। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা দীপনারায়ণ সিং রূপে মুগ্ধ হয়ে জাতের বাইরে বিয়ে করেছেন। সিভিল ম্যারেজ।’
‘তরুণীটি বুঝি সুন্দরী?’
‘সুন্দরী এবং বিদুষী। কলানিপুণা, নাচতে গাইতে জানেন, ছবি আঁকতে জানেন, তার ওপর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তেজস্বিনী ছাত্রী, বি. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।’
‘দীপনারায়ণ সিং দেখছি ভাগ্যবান এবং প্রগতিশীলও বটে।’
‘আগে এতটা প্রগতিশীল ছিলেন না। এতদিন ওঁর বাড়িতে মেয়েদের পর্দা ছিল। এখন একেবারে পদ ফাঁক।’
‘ভালই তো। তাতে দোষটা কি?’
‘দোষ নেই। কিন্তু অনভ্যাসের ফোঁটা, কপাল চড় চড় করে। বিহারের লোক এখনও মন থেকে পদ প্রথা ত্যাগ করতে পারেনি, তাই মেয়েদের একটু স্বাধীনতা দেখলেই কানাঘুষো করে, চোখ ঠারাঠারি করে–’’
অতঃপর আমাদের আলোচনা স্ত্রী-স্বাধীনতার পথ ধরিয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে উপনীত হইল। ঘড়ির কাঁটাও ক্রমশ ন’টার দিকে যাইতেছে। রাত্রে বাড়ি ফিরিতে বেশি দেরি করিলে সত্যবতী হাঙ্গামা করে। তাই আমরা অনিচ্ছাভরে উঠিবার উপক্বম করিলাম।
পাণ্ডেজি বলিলেন, চলুন, আপনাদের মোটরে করে পৌঁছে দিয়ে আসি।।’ পাণ্ডেজির আগে মোটর সাইকেল ছিল, এখন একটি ছোট মোটর কিনিয়াছেন।
আমরা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছি, এমন সময় ঘরের কোণে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। পাণ্ডেজি গিয়া ফোন ধরিলেন—’হ্যালো…হ্যাঁ, আমি পুরন্দর পাণ্ডে.দীপনারায়ণ সিং কথা বলতে চান?… নমস্তে নমস্তে… আপনার পার্টিতে যাবার খুবই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু…বন্ধুদেরও নিয়ে যাব?…তা-ওঁরা এখনও এখানেই আছেন, ওঁদের জিগ্যেস করে বলছি-?’
টেলিফোনের মুখে হাত চাপা দিয়া পাণ্ডেজি আমাদের দিকে ফিরিলেন, ‘দীপনারায়ণ সিং আপনাদেরও পার্টিতে নিয়ে যেতে বলছেন। কি বলেন?’