বিস্মিত পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘এখন-এই রাত্ৰে!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যেতে হলে আজ রাত্রেই যেতে হয়। ডাক্তার পালিত যে-রকম তাড়াতাড়ি চলে গেলেন, মিস ল্যাম্বার্টকে তালিম দিতে গেলেন। কিনা বুঝতে পারছি না। চলুন।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘চলুন।’
মিস ল্যাম্বার্ট ইঙ্গ-ভারতীয় মহিলা। বয়স হইয়াছে। তাঁহার চেহারায় ইঙ্গ ভাবই প্রবল, চোখ কটা, রঙ ফসর্ণ। কিন্তু মনটি বোধহয় ভারতীয়। ডিনারের পর পান খাইয়া ঠোঁট দু’টি লাল করিয়া বসিয়া রেডিও শুনিতেছিলেন, আমাদের পরিচয় পাইয়া সমাদর সহকারে ড্রয়িং রুমে বসাইলেন। ছোট্ট বাড়ির ছোট্ট ড্রয়িংরুম, বেশ ছিমছাম। মানুষটিও ছিমছাম। ডাক্তার পালিত এদিকে আসিয়াছিলেন বলিয়া মনে হইল না।
মিস ল্যাম্বার্ট হাসিয়া বলিলেন, ‘এত রাত্রে আপনাদের কি দিয়ে অতিথি সৎকার করব? পান খান।’ বলিয়া পানের বাটা আমাদের সামনে খুলিয়া ধরিলেন। আমরা পান লইলাম। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আপনার রাত্রে কোথাও যাবার নেই তো?’
মিস ল্যাম্বার্ট বলিলেন, ‘না, আজ আমি ফ্ৰী আছি।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আমরা আপনার কাছ থেকে একটা কথা জানতে এসেছি। দীপনারায়ণ সিং মারা গেছেন শুনেছেন কি?’
মিস ল্যাম্বাটের মুখ গভীর হইল, ‘শুনেছি। ডক্টর পালিতের হাতে এরকম ব্যাপার ঘটবে কল্পনা করাও যায় না।’
‘আপনি কার কাছে শুনলেন?’
‘ডক্টর জগন্নাথ প্রসাদের কাছে। তারপর অন্য ডক্টরদের মুখেও শুনলাম। সে স্যাড। বলুন আমি কি করতে পারি।’
পাণ্ডেজি তখন আমাদের জ্ঞাতব্য বিয়ষটি প্রাঞ্জল করিয়া বলিলেন। মিস ল্যাম্বার্ট গভীর মনোযোগের সহিত শুনিয়া দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িলেন, ‘ইমপসিবল। আমি দেড় মাস মিস্টার দীপনারায়ণের শুশ্রূষা করেছিলাম, তার মধ্যে কখনও দশ মিনিটের জন্যেও রুগীকে চোখের আড়াল করিনি।’
‘আপনি একাই তাঁর শুশ্রূষা করতেন?’
‘না, আমার একজন সহকারিণী ছিলেন-মিস দস্তুর। তিনি দিনের বেলা থাকতেন, আর রাত্ৰিতে আমি। আমাদের অনুপস্থিতি কালে কাউকে রুগীর কাছে যেতে দেওয়া হত না, এমন কি ঝি চাকরকে পর্যন্ত না।’
‘হুঁ। কবে থেকে কবে পর্যন্ত আপনারা শুশ্রূষা করেছিলেন?’
‘এক মিনিট, আমার ডায়েরি আপনাকে দেখাচ্ছি।’
মিস ল্যাম্বার্ট পাশের ঘর হইতে ডায়েরি আনিয়া পাণ্ডেজির হাতে দিলেন। ডায়েরিতে দিনের পর দিন মিস ল্যাম্বার্টের কর্মসূচী লিপিবদ্ধ হইয়াছে। যে দেড় মাস দীপনারায়ণ সিং-এর জীবন লইয়া যমে মানুষে টানাটানি চলিয়াছিল তাহার ব্বিরণ রহিয়াছে।
রোগীর অবস্থার বর্ণনা পড়িয়া সন্দেহ থাকে না যে ওই দেড় মাস অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন ছিল। তাঁহার জীবন-শক্তি এতাই হ্রাস হইয়াছিল যে বিছানায় উঠিয়া বসিবার শক্তি তাঁহার ছিল না। তারিখ মিলাইয়া দেখা গেল, মিস ল্যাম্বার্টের শুশ্রূষার কোল চার মাস আগে আরম্ভ হইয়া আজ হইতে আড়াই মাস আগে শেষ হইয়াছে। তার পরেও দীপনারায়ণ সিং অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু জীবনের আশঙ্কা তখন আর ছিল না।
ডায়েরি মিস ল্যাম্বার্টকে ফেরত দিয়া এবং তাঁহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইয়া আমরা বিদায় লইলাম।
রাত্রি সাড়ে ন’টা বাজিয়া গিয়াছে। বাজারের দোকানপাট বন্ধ। আজ বাড়ি ফিরিয়া সত্যবতীর কাছে বকুনি খাইতে হইবে ভাবিতে ভাবিতে বাড়ি ফিরিলাম। পাণ্ডেজি আমাদের নামাইয়া দিয়া গেলেন।
১১
পরদিন সকালে নিদ্রাভঙ্গ হইলে জানা গেল, রাত্রে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, আকাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন; সূর্যদেব কম্বল মুড়ি দিয়া ওইয়া আছে। সুতরাং আমাদেরও শয্যাত্যাগ করিয়া লাভ নাই।
সাড়ে আটটার সময় সত্যবতী চা দিতে আসিয়া বলিল, ‘আজ আবার অমাবস্যা। আজ কেউ বাড়ির বার হতে পাবে না।’
এমন দিনে কে বাহির হইতে চায়? কিন্তু পাণ্ডেজি শুনলেন না, ঠিক নাটার সময় পুলিস-বেশে সজ্জিত হইয়া উপস্থিত হইলেন। আমরা কম্পিত কলেবরে লেপের ভিতর হইতে নিৰ্গত হইলাম। পাণ্ডেজি আমাদের অবস্থা দেখিয়া হাসিলেন। বলিলেন, ‘কাল রাত্রে একটা ব্যাপার ঘটেছে।’
কি ব্যাপার ঘটিয়াছে ব্যোমকেশ জানিতে চাহিল, পাণ্ডেজি সংক্ষেপে ঘটনা বলিলেন—
কাল রাত্ৰি বারোটা হইতে আকাশে কুয়াশা জমিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তারপর টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়। পাণ্ডেজির দেরিতে ঘুমানো অভ্যাস; রাত্রি প্রায় দেড়টার সময় তিনি শয়নের উপক্রম করিতেছিলেন এমন সময় টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। দীপনারায়ণের বাড়ি হইতে টেলিফোন, যে জমাদারকে রতিকান্ত চারজন কনস্টেবল সঙ্গে পাহারায় রাখিয়াছিল। সে টেলিফোন করিতেছে। জমাদার জানাইল-কিছুক্ষণ আগে দুইজন লোক খিড়কির দরজা দিয়া হাতায় প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল; কিন্তু সিপাহীরা সতর্ক ছিল, তাই প্রবেশ করিতে গিয়া সিপাহীদের দেখিয়া পলায়ন করিয়াছে। একজন সিপাহী দূর হইতে তাহাদের উপর টর্চের আলো ফেলিয়াছিল, দু’জনেই কোট-প্যান্ট পরা ভদ্রশ্রেণীর লোক, কিন্তু তাহাদের সনাক্ত করা যায় নাই। মনে হয় তাহারা মোটর বাইকে চড়িয়া আসিয়াছিল, কারণ কিছুক্ষণ পরে দূরে মোটর বাইকের ফট্ ফট্ শব্দ শুনা গিয়াছিল।
পাণ্ডেজি রাত্রে আর কিছু করেন নাই, জমাদারকে সতর্কভাবে পাহারা দিবার উপদেশ দিয়া টেলিফোন ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। তারপর আজ সকালে খোঁজ লইয়া জানিয়াছেন যে রাত্রে আর কোনও উপদ্রব হয় নাই।
ব্যোমিকশে ভ্রূ তুলিয়া কিছুক্ষণ পাণ্ডেজির পানে চাহিয়া রহিল। আমি বলিলাম, নর্মদাশঙ্কর।’
ব্যোমকেশ আমার দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল, ‘আমি ভাবছি। অন্য লোকটা কে? নর্মদাশঙ্করই যদি দুষ্মন্ত হয় তাহলে সে কি একজন বয়স্যকে সঙ্গে নিয়ে শকুন্তলার কুঞ্জে যাবে?—পাণ্ডেজি, আপনার কি মনে হয়?’