পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘কিছু বুঝতে পারছি না। আমি দুটো ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি, ওয়ারেন্টে আসামীর নাম নেই, দরকার হলে বসিয়ে দেওয়া যাবে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে চলুন, নর্মদাশঙ্করের বাড়িতে হানা দেওয়া যাক। হঠাৎ আমাদের দেখলে ঘাবড়ে গিয়ে সত্যি কথা বলে ফেলতে পারে।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা তৈরি হইয়া বাহির হইলাম। সত্যবতী কিছু বলিল না, কেবল কটমট করিয়া তাকাইল।
মোটরে উঠতে গিয়া দেখিলাম ভিতরে একজন পুষ্টকায় সাব-ইন্সপেক্টর বসিয়া আছে। পাণ্ডেজি পরিচয় করাইয়া দিলেন–সাব-ইন্সপেক্টর তিওয়ারী।
তিওয়ারীর চেহারা সাবেক আমলের দারোগার মত। সে পোকা-ধরা দাঁত বাহির করিয়া স্যালুট করিল। বুঝিলাম রতিকান্ত তাহাকেই থানার চার্জে রাখিয়া গিয়াছে।
এদিকে আকাশের অশ্রুবাষ্প ক্রমশ অপসৃত হইতে আরম্ভ করিয়াছিল, সদ্য-জাগ্বত সূর্যদেব শাণিত খড়গ দিয়া তাহাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতেছিলেন। এতক্ষণ যাহা ভারী মেঘের মত আকাশের বুকে চাপিয়া ছিল তাহা ধুমকুণ্ডলীর মত মিলাইয়া যাইতে লাগিল। আমরা নর্মদাশঙ্করের বাড়িতে পৌঁছিতে পৌঁছিতে কাঁচা সোনালী রৌদ্রে চারিদিক ঝলমল করিয়া উঠিল।
নর্মদাশঙ্করের বাড়ি শহরের নূতন অংশে। ঢালাই লোহার রেলিং দিয়া ঘেরা, সামনে টেনিস কোর্ট। আমরা বাহিরে মোটর রাখিয়া যথাসম্ভব নিঃশব্দে প্রবেশ করিলাম। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল এখনও এ বাড়ির ভাল করিয়া ঘুম ভাঙে নাই। সম্মুখের বারান্দায় পা ছড়াইয়া বসিয়া একটা নিদ্ৰালু চাকর কয়েক জোড়া জুতা বুরুশ করিতেছে। আমাদের দেখিয়া কিছুক্ষণ মুখ-ব্যাদান করিয়া রহিল।
ব্যোমকেশ তাহার কাছে গিয়া টপ করিয়া এক জোড়া জুতা তুলিয়া লইল এবং উল্টাইয়া দেখিল। চাকরকে প্রশ্ন করিল, ‘এ জুতো কার?’
চাকরিটা হাঁ-করা অবস্থায় বলিল, ‘মালিকের।’
ব্যোমকেশ জুতা জোড়ার তলদেশ আমাদের দেখাইল। তলায় কাদা লাগিয়া আছে। রাত্রি বারোটার পর যে এই জুতা ব্যবহার হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
এই সময় বাড়ির ভিতর হইতে একজন উচ্চশ্রেণীর উর্দিপরা বেয়ারা বাহির হইয়া আসিল। সেও দু’জন পুলিস অফিসারকে দেখিয়া থতমত খাইয়া গেল। পাণ্ডেজি কড়া সুরে তাহাকে বলিলেন, নর্মদাশঙ্করবাবু কোথায়?’
বেয়ারা ভয়ে পাইয়া বলিল, ‘আজ্ঞে, তিনি বাড়িতেই আছেন।‘
‘নিয়ে চল আমাদের তাঁর কাছে।’
বেয়ারা একবার একটু ইতস্তত করিল, তারপর পথ দেখাইয়া আমাদের লইয়া চলিল। বাড়ির অভ্যন্তর যতদূর দেখিলাম সুরুচির সহিত সজ্জিত। বেয়ারা আমাদের একটি দরজার সম্মুখে আনিয়া পদ সরাইয়া দাঁড়াইল। আমরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।
ঘরের জানালা দরজা বন্ধ, বৈদ্যুতিক আলো জ্বলিতেছে। ঘরটিকে শিকারের ঘর বলা চলে। মেঝোয় বাঘ ও হরিণের চামড়া ছড়ানো, দেয়ালে বাঘ ও হরিণের মুণ্ড। একটি কাচের আলমারিতে রাইফেল বন্দুক পিস্তল প্রভৃতি সাজানো রহিয়াছে। ঘরের মাঝখানে একটি গোল টেবিল, তাহাকে ঘিরিয়া কয়েকটি গদি-মোড়া আরাম-কেদারা।
আমরা প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, দু’টি লোক মুখোমুখি দু’টি কেদারায় বসিয়া আছে; তাহাদের হাতে কাচের গেলাসে রঙীন তরল পদার্থ। পাশের টেবিলে সোডা ও হুইস্কির বোতল। সুতরাং গেলাসের তরল পদার্থ যে কী বস্তু তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। বোধহয় মধ্য রাত্রে যে সোমযাগ আরম্ভ হইয়াছিল। তাহা এখনও চলিতেছে।
আমাদের দিকে মুখ করিয়া যে লোকটি বসিয়া ছিল সে ঘোড়া জগন্নাথ। ঘোলাটে চোখে আমাদের দেখিতে পাইয়া তাহার সমস্ত শরীর বিদ্যুৎপৃষ্ট্রের মত ঝাঁকানি দিয়া উঠিল; হাতের গেলাস হইতে তরল পদার্থ চলাকাইয়া পড়িল। তখন নর্মদাশঙ্কর ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল। তাহার আরক্ত মুখে ভ্রূকুটি দেখা দিল। সে রূঢ় স্বরে বলিল, ‘কি চাই?
মদের বিচিত্র প্রভাব; পেটে মদ পড়িলে মানুষের চরিত্র বদলাইয়া যায়। কেহ কাঁদে্্, কেহ গান গায়, কেহ বা যুযুৎসু হইয়া ওঠে। নর্মদাশঙ্করের বিনীত বশংবদ ভাব আর নাই, সে উগ্র সম্পধিত চক্ষে আমাদের পানে চাহিয়া রহিল।
পাণ্ডেজি তাহাদের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার কণ্ঠস্বরে পুলিসী কঠোরতা ফুটিয়া উঠিল, ‘আপনাদের দু’জনের নামে ওয়ারেন্ট আছে।’
নর্মদাশঙ্কর মদের গেলাস হাতে উঠিয়া দাঁড়াইল, উদ্ধত বিস্ময়ে বলিল, ‘ওয়ারেন্ট! আমার নামে? কিসের ওয়ারেন্ট?’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আপনারা দু’জনে কাল রাত্রি একটার সময় দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে ট্রেসপাস করেছিলেন।’
‘প্রমাণ আছে?’
পাণ্ডেজি অবিচলিত কণ্ঠে বলিলেন, ‘আছে। পুলিসের লোকে আপনাকে দেখেছে।’
নর্মদাশঙ্করের রক্ত–রাঙা চোখে কুটিল বজ্জাতি খেলিয়া গেল, সে ঠোঁটের একটা তেরছা ভঙ্গী করিয়া বলিল, ‘যদি বলি শকুন্তলা আমাকে ডেকেছিল তাহলেও কি ট্রেসম্পাস হবে?
‘সেকথা আদালতে বলবেন।–সাব-ইন্সপেক্টর তিওয়ারী–’ পাণ্ডেজি তিওয়ারীকে ইঙ্গিত করিলেন, তিওয়ারী পকেট হইতে দুই জোড়া হাতকড়া বাহির করিল।
হাতকড়া দেখিয়া ঘোড়া জগন্নাথ হাউমাউ করিয়া উঠিল। এতক্ষণ সে চুপটি করিয়া ছিল, নাক ঝাড়ার শব্দ পর্যন্ত করে নাই। এখন মদের গেলাস টেবিলে রাখিয়া দুহাতে পাণ্ডেজির হাত চাপিয়া ধরিল, ব্যগ্র মিনতির কণ্ঠে বলিল, ‘পাণ্ডেজি, দোহাই আপনার, হাতে হাতকড়া পরাবেন না। আমরা সত্যিকারের দোষ কিছু করিনি, আপনাকে সব কথা বলছি-না না, নর্মদাশঙ্কর, তুমি চুপ কর, গোঁয়াতুমি কোরো না—এসব কেচ্ছা জারি হয়ে পড়লে শহরে আর মুখ দেখানো যাবে না। পাণ্ডেজি, আমার বয়ান শুনুন–’