বহ্নি-পতঙ্গ

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘আপনি যদি সত্যি কথা বলেন শুনতে রাজী আছি।’

‘সত্যি কথা বলব‌, কোনও কথা লুকোব না।’

‘বেশ‌, শুনে যদি মনে হয় আপনাদের কোনও মন্দ অভিপ্ৰায় ছিল না‌, তাহলে অ্যারেস্ট নাও করতে পারি। —নর্মদাশঙ্করবাবু্‌, আপনি যান‌, অনেক মদ খেয়েছেন‌, বিছানায় শুয়ে থাকুন গিয়ে। দরকার হলে ডাকব।’

এতক্ষণে নর্মদাশঙ্করেরও কতকটা কুঁশি হইয়াছিল; সে আমাদের দিকে একটি ব্যর্থ ক্রোধের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া মদের বোতলটা তুলিয়া লইয়া প্রস্থান করিল।

আমরা তখন উপবেশন করিলাম। ঘোড়া জগন্নাথ কোঁৎ কোৎ করিয়া গেলাসের বাকি মদ গলাধঃকরণ করিয়া যে ঘটনা বিবৃত করিল। তাহার মমর্থ এইরূপ–

নর্মদাশঙ্করের সঙ্গে ঘোড়া জগন্নাথের বন্ধুত্ব খুব গাঢ় নয়; তবে নর্মদাশঙ্করের বাড়িতে আসিলে বিনা পয়সায় বিলাতি মন্দ পাওয়া যায়‌, তাই জগন্নাথ তাহার সহিত একটা বাহ্যিক সৌহৃদ্য রাখিয়াছে। কাল রাত্রে জগন্নাথ আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এখানে আসিয়াছিল‌, তারপর এখানেই আহারাদি সম্পন্ন করে। অন্যান্য বন্ধুরা প্রস্থান করিলে জগন্নাথ ও নর্মদাশঙ্কর এই ঘরে আসিয়া মদ্য পান করিতে আরম্ভ করে। নর্মদাশঙ্করকে কাল সন্ধ্যাকালে পুলিস শকুন্তলার সহিত সাক্ষাৎ করিতে দেয় নাই‌, সেজন্য তাহার মনে গভীর ক্ষোভ ছিল; মদ খাইতে খাইতে এই প্রসঙ্গই আলোচনা হয়। ক্রমে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইল‌, বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ করিল। হঠাৎ নর্মদাশঙ্কর বলিল‌, আজ রাত্রে যেমন করিয়া হোক শকুন্তলার সহিত দেখা করিবে। জগন্নাথ তাহাকে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল‌, কিন্তু সে শুনিল না। তখন দুইজনে মোটর বাইকে চড়িয়া বাহির হইল‌, জগন্নাথ মোটর বাইকের পিছনের আসনে বসিল। দীপনারায়ণের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছিয়া তাহারা আমবাগানের মধ্যে মোটর বাইক লুকাইয়া রাখিল‌, তারপর খিড়কির দরজা দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। কিন্তু পুলিস পাহারায় ছিল‌, খিড়কির দরজা পার হইতে না হইতে তাহারা বৈদ্যুতিক টর্চের আলো ফেলিয়া আগন্তুক দু’টিকে দেখিতে পাইল। দু’জনে তখন আর কালবিলম্ব না করিয়া পলায়ন করিল এবং মোটর বাইকে চাপিয়া ফিরিয়া আসিল। তারপর হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত তাহারা এখানে বসিয়া মদ্য পান করিয়াছে। তাহাদের কোনও বে-আইনী অভিসন্ধি ছিল না‌, মদের ঝোঁকে একটা নিবুদ্ধিতার কাজ করিয়া ফেলিয়াছে। এখন এই সব বিবেচনা করিয়া পাণ্ডেজি নিজ গুণে তাহদের ক্ষমা করুন।

ঘোড়া জগন্নাথের অনুনয়ান্ত বিবৃতি শেষ হইবার পর পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের দিকে ভূভঙ্গ করিলেন। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে নর্মদাশঙ্করবাবুর সম্বন্ধটা ঠিক কোন ধরনের?

জগন্নাথ সন্ত্রস্ত হইয়া বলিল‌, ‘দেখুন‌, ওসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন না। মানে–’

‘মানে-আপনি বলবেন না?’

জগন্নাথ আরও সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল‌, ‘না না‌, বলব না কেন? তবে ওসব কথায় আমি থাকি না—আমি একজন রেসপেক্টবল ডাক্তার-কাজ কি আমার পরের হাঁড়িতে কাঠি দিয়ে।’

‘বটে! আপনি পরের হাঁড়িতে কাঠি দেন না! কেবল ডাক্তার পালিতের কম্পাউন্ডার খুবলালকে চাকরি ছেড়ে দেবার জন্য ভয় দেখিয়েছিলেন।’

খুবলালের উল্লেখে ঘোড়া জগন্নাথ একবারে কেঁচো হইয়া গেল–’আমি-মানে আমি—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওকথা যাক। শকুন্তলার সঙ্গে নর্মদাশঙ্করের ঘনিষ্ঠতা কতদূর গড়িয়েছে তা আপনি জানেন না?’

‘সত্যি বলছি নাটঘটের কথা আমি কিছু জানি না।’

‘কাল রাত্রে নর্মদাশঙ্কর কিছু বলেনি?’

নর্মদাশঙ্কর ভারি মিথ্যেবাদী। ও মনে করে দুনিয়ার সব মেয়ে ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওর কথা বিশ্বাস করা যায় না।’

‘অর্থাৎ বলেছিল। কী বলেছিল?’

‘বলেছিল শকুন্তলার সঙ্গে অনেক দিন ধরে ওর প্রেম চলছে। এলাহাবাদে ওরা এক কলেজে পড়ত‌, তখন থেকে প্ৰেম।’

ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, নীরসকণ্ঠে বলিল‌, ‘হঁ! আজ আপনি ছাড়া পেলেন। কিন্তু পরে হয়তো আদালতে সাক্ষী দিতে হবে। শহর ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করবেন না‌, তাহলেই হাতে হাতকড়া পড়বে। চলুন‌, পাণ্ডেজি।’

১২

দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে পৌঁছিয়া পাণ্ডেজি তিওয়ারীকে বলিলেন‌, ‘তুমি এবার থানায় ফিরে যাও‌, তোমাকে এখানে আর দরকার নেই।’ তিওয়ারী প্রস্থান করিলে তিনি ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘অতঃ কিম?

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিল‌, ‘আসুন‌, সেরেস্তার দিকে যাওয়া যাক। মনে হল যেন। ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে সুট করে দপ্তরখানায় ঢুকে পড়লেন।’

ফটিক অতিক্বম করিয়া আমরা সেরেস্তার দিকে চলিলাম। পথে জমাদারের সঙ্গে দেখা হইল; সে পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিয়া জানাইল‌, সব ঠিক আছে।

সেরেস্তার ঘরগুলি কাল আমরা বাহির হইতে দেখিয়াছিলাম। এক সারিতে গুটি তিনেক ঘর; প্রত্যেক ঘরে তক্তপোশের উপর জাজিম পাতা। কয়েকজন কেরানি বসিয়া কাজ করিতেছে। ম্যানেজার গঙ্গাধর যখন দেখিলেন আমাদের এড়াইতে পারিকেন না‌, তখন তিনি সেরেস্তা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। তাঁহার হাতে এক তাড়া বহিগামী চিঠি। আমাদের যেন এই মাত্র দেখিতে পাইয়াছেন এমনিভাবে মুখে একটি সচেষ্ট হাসি আনিয়া বলিলেন‌, ‘এই যে!’

ব্যোমকেশ চিঠিগুলি লক্ষ্য করিয়া বলিল‌, ‘দেওয়ানজি‌, আপনার সেরেস্তা থেকে রোজ কত চিঠি ডাকে যায়?’

দেওয়ানজি চিঠিগুলি একজন পিওনের হাতে দিলেন‌, পিওন সেগুলি লইয়া খিড়কির দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল; বাড়ির কোণে যে ডাক-বাক্স আছে তাহাতেই ফেলিতে গেল সন্দেহ নাই। দেওয়ানজি বলিলেন‌, ‘তা কুড়ি-পঁচিশখানা যায়। অনেক লোককে চিঠি দিতে হয়–উকিল মোক্তার খাতক প্রজা—‘

0 Shares