বহ্নি-পতঙ্গ

ব্যোমকেশ বলিলবাড়ির কোণে যে ডাক-বাক্সটা আছে তাতেই সব চিঠিপত্র ফেলা হয়?’

গঙ্গাধর বলিলেন‌, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ! ও ডাক-বাক্সটা আমরা ডাক বিভাগের সঙ্গে লেখালেখি করে ওখানে বসিয়েছি। হাতের কাছে একটা ডাক-বাক্স থাকলে সুবিধা হয়।’

‘তা তো বটেই। কবার ক্লিয়ারেন্স হয়?’

‘একবার ভোর সাতটায়‌, একবার বিকেল চারটেয়। কিন্তু কেন বলুন দেখি? ডাক-বাক্সের সঙ্গে আপনাদের তদন্তের কোনও সম্পর্ক আছে নকি?’

‘থাকতেও পারে। দেওয়ানজি‌, আমাদের ভাষায় এক বয়েৎ আছে-যেখানে দেখিবে ছাঁই‌, উড়াইয়া দেখ তাই‌, পাইলে পাইতে পার লুকানো রতন। কিন্তু যাক ওকথা। এদিকের খবর কি?’

গঙ্গাধর হাত উল্টাইয়া বলিলেন‌, ‘খবর আমি তো কিছুই জানি না। এমন কি মালিকের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পর্যন্ত এখনও জানতে পারিনি। সত্যিই কি ইনজেকশনে বিষ ছিল?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ডাক্তারেরা তো তাই বলেছেন। ভাল কথা‌, ডাক্তার পালিতের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?’

গঙ্গাধর বংশীর মুখখানি হঠাৎ যেন চুপসিয়া গেল‌, চক্ষু দু’টি কোটরের মধ্যে অন্তৰ্হিত হইল। তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া ঈষৎ স্বলিত স্বরে বলিলেন‌, ‘দেখা হয়েছিল। তিনি টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করছেন।’

‘আপনি কি নিজের হাতে টাকা দিয়েছিলেন?’

গঙ্গাধর আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন‌, শেষে বলিলেন‌, ‘না‌, অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজার টাকা দিয়েছিল।’

‘অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার মানে—আপনার ছেলে লীলাধর বংশী?’

গঙ্গাধর বুজিয়া যাওয়া কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করিয়া বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। মুশকিল হয়েছে‌, রসিদ নেওয়া হয়নি। ডাক্তার পালিত যে এ রকম করবেন–’

‘সত্যিই তো-ভাবাও যায় না।–তা লীলাধরবাবু এখন কোথায়?’

‘সে-সে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে।’

‘তাই নাকি! কাল সন্ধ্যে পর্যন্ত এখানে ছিলেন‌, দেবনারায়ণের ঘরে বসে তাড়ি খাচ্ছিলেন‌, আজ একেবারে শ্বশুরবাড়ি।’

গঙ্গাধর অস্পষ্ট জড়িতস্বরে বলিলেন‌, ‘তার স্ত্রীর অসুখ. হঠাৎ খবর পেয়ে চলে গেছে।’

‘হুঁ-ব্যোমকেশের চোখে দুষ্ট-বুদ্ধি নাচিয়া উঠিল‌, সে তখন চিন্তা-মন্থর ভঙ্গীতে বলিল‌, ‘টাকা তো কম নয়-বারো হাজার। স্টেটের এতগুলো টাকা মারা যাবে‌, দেওয়ানজি‌, আপনার উচিত পুলিসে এত্তেলা দেওয়া। রসিদ না দিলেও টাকা যে ডাক্তার পালিত নিয়েছেন তা পুলিস। অনুসন্ধান করে বার করতে পারবে।–কি বলেন পাণ্ডেজি?’

পাণ্ডেজি দৃঢ়স্বরে বলিলেন‌, ‘নিশ্চয়। ম্যানেজার সাহেব বলুন‌, আমরা এখনি তদন্ত আরম্ভ করছি। দপ্তরের সমস্ত কাগজপত্র আমরা পরীক্ষা করে দেখব; যদি কোথাও গরমিল থাকে ধরা পড়বেই। ডাক্তার পালিত এবং লীলাধরকেও জেরা করব‌, তাঁদের তল্লাসী নেব–’

ব্যোমকেশ ও পাণ্ডেজি মিলিয়া ম্যানেজার সাহেবকে কোন অতট প্রপাতের কিনারায় ঠেলিয়া লইয়া যাইতেছেন তাহা অনুমান করা তাঁহার মত গভীর জলের মাছের পক্ষে কঠিন নয়। তিনি উদাসভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘না‌, ডাক্তার পালিত যখন অস্বীকার করছেন তখন আমিই ও-টাকা পুরিয়ে দেব। আমার লোকসানের বরাত‌, গচ্ছা দিতে দিতেই জন্ম কেটে গেল।’ বলিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলেন।

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিল। পাণ্ডেজি গলার মধ্যে একটা আওয়াজ করিলেন‌, কিন্তু আওয়াজটা সহানুভূতিসূচক নয়।

দেওয়ানজিকে সেরেস্তায় রাখিয়া আমরা বাড়ির সদরে উপস্থিত হইলাম। বাহিরের হল-ঘরে একজন সিপাহী পাহারায় ছিল; তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল‌, বাড়ির সবাই উপরিতলায় আছে। আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিলাম।

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়াইয়া আছে চাঁদনী; চক্ষু দু’টি রক্তবর্ণ‌, মাথার চুল এলোমেলো। তাহার চেহারা যদি স্বভাবতাই মিষ্ট এবং নরম না হইত। তাহা হইলে বলিতাম‌, রণরঙ্গিনী মূর্তি। সে আমাদের দেখিবামাত্র কোনও প্রকার ভূমিকা না করিয়া আরম্ভ করিল‌, ‘আপনারা নাকি চাচিজির কাছে আমার যাওয়া বারণ করে দিয়েছেন! কী ভেবেছেন আপনারা? আমি চাচিজিকে বিষ খাওয়াব?’

অতর্কিত আক্রমণে আমরা বিমূঢ় হইয়া পড়িলাম। ব্যোমকেশ অসহায়ভাবে পাণ্ডেজির পানে চাহিল‌, পাণ্ডেজি মাথা চুলকাইয়া অপ্রস্তুতভাবে বলিলেন‌, ‘দেখুন‌, শুধু আপনাকেই বারণ করা হয়নি‌, ওঁর কাছে এখন কারুরই যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আর দু’চার দিনের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে‌, তখন আবার আপনারা ওঁর কাছে যেতে পারবেন।’

চাঁদনী আবেগভরে বলিল‌, ‘কিন্তু কেন? আমি ওঁর। যেমন সেবা করতে পারব। আর কেউ কি তেমন পারবে? তবে কেন আমাকে ওঁর কাছে যেতে দেওয়া হবে না? উনি অসুস্থ, এতবড় শোক পেয়েছেন–’

চাঁদনীর চোখ দিয়া দরদীর ধারায় জল পড়িতে লাগিল। এবার পাণ্ডেজি অসহায়ভাবে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন।

ব্যোমকেশ এতক্ষণে সামলাইয়া লইয়াছে‌, সে শাস্তকণ্ঠে বলিল‌, ‘আপনি বোধহয় জানেন না‌, শকুন্তলা দেবী অন্তঃসত্ত্বা। তার ওপর এতবড় আঘাত পেয়েছেন। ওঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ‌, তাই মিস মান্নাকে ওঁর কাছে রাখা হয়েছে। আপনারা ওঁর নিজের লোক‌, আপনারা ওঁর কাছে বেশি যাওয়া-আসা করলে ওঁর মন আরও বিক্ষিপ্ত হবে‌, তাতে ওঁর শরীরের অনিষ্ট হতে পারে। তাই ওঁর কাছ থেকে কিছুদিন আপনাদের দূরে থাকাই ভাল।’

ব্যোমকেশ কথা বলিতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদনী সম্মোহিতের ন্যায় স্থির চক্ষু হইয়া গিয়াছিল। ব্যোমকেশ থামিলে সে তন্দ্রাহতের মত অস্ফুট স্বরে বলিল‌, ‘অন্তঃসত্ত্বা—/ তারপর তেমনই মোহাচ্ছন্নভাবে নিজের মহলের দিকে ফিরিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শুনুন। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে–চাঁদনী ফিরিয়া দাঁড়াইল—’দীপনারায়ণবাবুকে যখন ইনজেকশন দেওয়া হয় তখন আপনি উপস্থিত ছিলেন?

0 Shares