বহ্নি-পতঙ্গ

প্রশ্নটা চাঁদনী পুরা শুনিতে পাইল কিনা বলা যায় না‌, অস্পষ্টভাবে বলিল‌, ‘ছিলাম।’

‘সেখানে আর কেউ ছিল?’

‘জানি না। লক্ষ্য করিনি।’

‘মন দিয়ে আমার প্রশ্ন শুনুন। ডাক্তারবাবুকি কি করলেন মনে করবার চেষ্টা করুন।’

‘ডাক্তারবাবু ইনজেকশন দিতেই চাচাজি এলিয়ে পড়লেন। তখন ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি আর একটা ইনজেকশন দিলেন। আমি ছুটে গেলাম চাচিজিকে খবর দিতে। ফিরে এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।’

‘ফিরে এসে সেখানে আর কাউকে দেখেছিলেন?’

‘মনে নেই। বোধহয় দেওয়ানজি ছিলেন‌, আর কাউকে লক্ষ্য করিনি।’–চাঁদনী আর প্রশ্নের অপেক্ষা না করিয়া নিজের মহলে চলিয়া গেল।

ব্যোমকেশ মাটির দিকে তাকাইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল‌, শেষে মুখ তুলিয়া বলিল‌, চলুন‌, এবার শকুন্তলা দেবীর ঘরে যাওয়া যাক।।’

আগে আগে ব্যোমকেশ‌, পিছনে আমরা চলিলাম। বসিবার ঘর শূন্য‌, আসবাবগুলির উপর সূক্ষ্ম ধূলার আস্তরণ পড়িয়াছে। পরের ঘরটিও তাই। তৃতীয় কক্ষে্‌্‌, অর্থাৎ শকুন্তলার গানবাজনার ঘরের সম্মুখে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দাঁড়ান‌, ছবিটা আর একবার দেখে নিই।’

ব্যোমকেশ ঘরে প্রবেশ করিল। আমরা দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিলাম‌, ছবি দেখিবার বিশেষ আগ্রহ আমাদের ছিল না।

যে দেয়ালে দুষ্মন্ত শকুন্তলার পূর্বরাগ চিত্রটি আঁকা ছিল ব্যোমকেশ সেইদিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। পাঁচ মিনিট আর তাহার দেখা নাই। আমি দরজা দিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিলাম সে মগ্ন-সমাহিত হইয়া ছবি দেখিতেছে। আমি একটু শ্লেষ করিয়া বলিলাম‌, ‘কি হে‌, একেবারে তন্ময় হয়ে গেলে যে! কী দেখছ এত?’

ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে ফিরিল। দেখিলাম তাহার চোখের দৃষ্টি কেমন একরকম হইয়া গিয়াছে‌, যেন একটা অভিভূত বিস্ময়াহত ভাব। সে আমার কথার উত্তর দিল না‌, মখমলের বিছানায় আসিয়া বসিল‌, উত্থিত হাঁটু দুটাকে বাহু দিয়া জড়াইয়া শূন্য পানে চাহিয়া রহিল।

তাহার ভাবভঙ্গী দেখিয়া পাণ্ডেজি ও আমি ঘরে প্রবেশ করিলাম। পাণ্ডেজি‌, ঈষৎ উদ্বিগ্নভাবে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, কি হয়েছে? ছবিতে কি দেখলেন?’ ব্যোমকেশ এবারও উত্তর দিল না; পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিয়া অতি যত্নে ধরাইল‌, তারপর সুদীর্ঘ টান দিয়া আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়িতে লাগিল।

আমি পাণ্ডেজির সহিত দৃষ্টি বিনিময় করিলাম‌, তারপর দু’জনে একসঙ্গে গিয়া ছবির সম্মুখে দাঁড়াইলাম। ছবি কাল যেমন দেখিয়াছিলাম‌, আজ দিনের আলোয় তাহার কোনও তফাৎ দেখিলাম না। শকুন্তলা তেমনি তরু-আলবালে জল সেচন করিতেছেন‌, দুষ্মন্ত তেমনি গাছের আড়াল হইতে উঁকি মারিতেছেন। তবে ব্যোমকেশ হঠাৎ এমন বোবা হইয়া গেল কেন?

আমরা ফিরিয়া গিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে বসিলাম এবং একদৃষ্টি তাহার পানে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিলাম। সে সিগারেট সম্পূর্ণ শেষ করিয়া জানোলা গলাইয়া ফেলিয়া দিল‌, তারপর পাণ্ডেজির হাত ধরিয়া গাঢ় স্বরে বলিল‌, ‘একটি অনুরোধ রাখতে হবে।’

‘কি অনুরোধ?’

‘আমি একা শকুন্তলার ঘরে গিয়ে তাঁকে জেরা করব‌, সেখানে আর কেউ থাকবে না।’

‘বেশ তো। কিন্তু কী পেলেন?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘সব পেয়েছি। আপনারাও তো ছবি দেখলেন‌, কিছু পেলেন না?’

পাণ্ডেজি ক্ষুব্ধভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘কৈ আর পেলাম। কাল রাত্রেও ছবি দেখেছি‌, আজও দেখলাম‌, কিন্তু রহস্যের চাবি তো পেলাম না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কাল রাত্রে নিওন-লাইটের নীল আলোতে দেখেছিলেন‌, কিন্তু আজ দিনের আলোয় দেখেছেন। আজ দেখতে না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যাহোক‌, আপনারা সামনের ঘরে গিয়ে বসুন‌, আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।’

ব্যোমকেশ গিয়া শকুন্তলার দ্বারে টোকা দিল‌, দ্বার খুলিয়া মিস মান্না বাহিরে আসিলেন। ব্যোমকেশ নিম্নস্বরে তাঁহাকে কিছু বলিল‌, তিনি ঘাড় নাড়িয়া আমাদের কাছে চলিয়া আসিলেন। ব্যোমকেশ শকুন্তলার ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

১৩

আমরা তিনজনে সামনের ঘরে গিয়া বসিলাম। মিস মান্না উৎসুক চোখে আমাদের পানে চাহিলেন। আমরা আর কী বলিব‌, নিজেরাই কিছু জানি না‌, মুখ ফিরাইয়া যামিনী রায়ের ছবি দেখিতে লাগিলাম।

পঁচিশ মিনিট পরে ব্যোমকেশ আসিল। তাহার মুখে চোখে কঠিন ক্লান্তি‌, যেন বুদ্ধির যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হইয়া অতি কষ্টে জয়ী হইয়াছে। সে মিস মান্নার পাশে বসিয়া নিম্ন কণ্ঠে তাঁহাকে নির্দেশ দিল। নির্দেশের মমর্থি; আজ রাত্রি সওয়া দশটা পর্যন্ত এক লহমার জন্য তিনি শকুন্তলাকে চোখের আড়াল করিবেন না‌, বা অন্য কাহারও সহিত জানাস্তিকে কথা বলিতে দিবেন। না। সওয়া দশটার পর মিস মান্নার ছুটি‌, তিনি তখন নিজের বাসায় ফিরিয়া যাইবেন। মিস মান্না নির্দেশ শুনিয়া পাণ্ডেজির প্রতি সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন‌, প্রত্যুত্তরে পাণ্ডেজি ঘােড় হেলাইয়া সায় দিলেন। মিস মান্না তখন শকুন্তলার ঘরে চলিয়া গেলেন।

ব্যোমকেশ পর্যায়ক্রমে আমার ও পাণ্ডেজির মুখের পানে চাহিয়া শুষ্ক হাসিল‌, ‘চলুন‌, এবার যাওয়া যাক।‘

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘কিন্তু—’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল‌, ‘এখানে নয়। বাড়ি যেতে যেতে সব বলব।’

সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ি হইতে বাহির হইবার পূর্বে জলযোগ করিতে করিতে ব্যোমকেশ আড় চোখে সত্যবতীর পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘আজ আমাদের ফিরতে একটু দেরি হবে।’

সত্যবতী মুখ ভার করিয়া বলিল‌, ‘তা তো হবেই। আজ অমাবস্যা‌, তার ওপর আমি বেরুতে মানা করেছি‌, আজ দেরি হবে না তো কবে হবে।’

0 Shares