বহ্নি-পতঙ্গ

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ অমাবস্যা নাকি! আরে‌, খুব লাগসৈ হয়েছে তো।’

সত্যবতী বলিল‌, ‘হয়েছে বুঝি? ভাল।’ ব্যোমকেশ বলিল ‘অজিত কবি মানুষ‌, ওকে জিগ্যেস কর‌, অভিসার করবার জন্যে অমাবস্যার রাত্রিই প্রশস্ত।’

‘তা সারা রাত্রি ধরেই কি অভিসার চলবে?’

‘আরো না না‌, বারোটা-একটার মধ্যেই ফিরব।’

সত্যবতী চকিত উদ্বেগ ভরে চাহিল‌, ‘বারোটা-একটা?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া মুখ মুছিতে মুছিতে লঘুস্বরে বলিল‌, ‘তুমি ভেবো না। ফিরে এসে তোমাকে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার উপাখ্যান শোনাব। —চল‌, অজিত।’

সত্যবতী শঙ্কিত মুখে দাঁড়াইয়া রহিল‌, আমরা বাহির হইলাম।

আমরা পাণ্ডেজির বাসায় না গিয়া সটান দীপনারায়ণের বাড়িতে গেলাম; সেই রূপই কথা ছিল। পাণ্ডেজি বাহিরের হল-ঘরে গদি-মোড়া চেয়ারে বসিয়া দুই পা সম্মুখ দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া খাড়া হইয়া বসিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘রতিকান্ত বক্সার থেকে এখনও ফেরেননি?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, না। থানায় খবর দেওয়া আছে। ফিরেই এখানে আসবে।’

‘অতঃপর আমরা তিনজনে বসিয়া নীরবে সিগারেট টানিতে লাগিলাম। অন্ধকার হইলে পাণ্ডেজি উঠিয়া একটা আলো জ্বালিয়া দিলেন, তাহাতে ঘরের কিয়ংদশ আলোকিত হইল মাত্র। …ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী একবার বাহির হইতে উঁকি মারিয়া নিঃসাড়ে অপসৃত হইলেন। চাঁদনী নীচে নামিয়া আসিয়া আমাদের দেখিয়া চুপি চুপি আবার উপরে উঠিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে একটা চাকর আসিয়া তিন পেয়ালা চা দিয়া গেল। আমরা চা পান করিলাম। …বাড়িটা যেন ভূতুড়ে বাড়ি; শব্দ নাই‌, ঘরের আনাচে কানাচে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমরা তিনটি প্রতীক্ষ্ণমান প্ৰেতাত্মার মত বসিয়া আছি; কেন বসিয়া আছি তাহা গভীর রহস্যে আবৃত।

পৌঁনে আটটার সময় রতিকান্ত আসিল। পরিধানে আগাগোড়া পুলিস বেশ‌, চোখে চাপা উত্তেজনা। সে পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিয়া তাঁহার পাশের চেয়ারের কিনারায় বসিল‌, পাণ্ডেজির দিকে ঝুকিয়া বলিল‌, ‘প্রমাণ পেয়েছি-ডাক্তার পালিতের কাজ।’

পাণ্ডেজি তীক্ষ্ণ নোত্রে রতিকাস্তের পানে চাহিয়া রহিলেন‌, বলিলেন‌, ‘প্রমাণ পেয়েছ? কি প্রমাণ—‘

রতিকান্ত বলিল‌, কয়েদীটো স্বীকার করেছে। প্রথমে কিছুই বলতে চায় না‌, অনেক জেরা করার পর স্বীকার করল যে‌, পালিত তার কাছে কিউরারি কিনেছে।’

‘তাই নাকি?’ পাণ্ডেজি যেন আত্ম-সমহিত হইয়া পড়িলেন।

রতিকান্ত উৎসুকভাবে বলিল‌, ‘তাহলে এবার বোধহয় পালিতকে অ্যারেস্ট করা যেতে পারে? ‘দাঁড়াও‌, অত তাড়াতাড়ি নয়। একটা ছিচকে চোরের সাক্ষীর ওপর ডাক্তার পালিতের মত লোককে অ্যারেস্ট করা নিরাপদ নয়। এদিকে আমরাও কিছু খবর সংগ্রহ করেছি-? বলিয়া পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিলেন। রতিকান্ত উচ্চকিত হইয়া ব্যোমকেশের পানে চোখে ফিরাইল‌, ‘কি খবর?’

বলছি—ব্যোমকেশ একবার সতর্কভাবে বৃহৎ কক্ষের চারিদিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিল‌, তারপর চেয়ার টানিয়া রতিকান্তের কাছে ঘেষিয়া বসিল। আবছায়া আলোয় চারিটি মাথা একত্ৰিত হইল। চুপি চুপি কথা হইতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ সকালবেলা শকুন্তলা দেবীকে জেরা করেছিলাম। প্রথমটা তিনি চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়লেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে অপরাধীকে তিনি চেনেন‌, অপরাধী তাঁর—গুপ্ত-প্রণয়ী। …’ ব্যোমকেশ চুপ করিল। রতিকান্ত নিনিমেষ চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিল‌, ‘কিন্তু মুশকিল হয়েছে‌, কিছুতেই অপরাধীর নাম বলছেন না।’

রতিকান্ত বলিয়া উঠিল‌, ‘নাম বলছেন না।’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল‌, ‘না। শকুন্তলা স্ত্রীলোক‌, তাঁর লজ্জা সঙ্কোচ আছে‌, কলঙ্কের ভয় আছে‌, তাই তাঁকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করেও অপরাধীর নাম তাঁর মুখ থেকে বার করতে পারলাম না।’

রতিকান্ত সোজা হইয়া বসিল‌, ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল‌, ‘আমি একবার চেষ্টা করে দেখব? আমি যদি একলা গিয়ে তাঁকে জেরা করি‌, তিনি হয়তো নামটা বলতে পারেন।’

পাণ্ডেজি মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘এখন আর হবে না‌, তিনি মুখ ফুটে কিছু বলবেন না। তবে অন্য একটা উপায় হয়েছে–’

‘কি উপায় হয়েছে? রতিকান্ত পাণ্ডেজির দিক হইতে ব্যোমকেশের দিকে চক্ষু ফিরাইল।

ব্যোমকেশ গলা আরও খাটো করিয়া বলিল‌, ‘অনেক ধ্বস্তাধবস্তির পর শকুন্তলা রাজী হয়েছেন‌, চিঠি লিখে পাণ্ডেজিকে অপরাধীর নাম জানাবেন। ব্যবস্থা হয়েছে‌, এখানে যে-সব পুলিস মোতায়েন আছে তাদের সরিয়ে নেওয়া হবে। শকুন্তলার কাছে থাকবেন শুধু মিস মান্না। আর কাউকে তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হবে না। রাত্রি সওয়া দশটার মধ্যে মিস মান্না শকুন্তলাকে একলা রেখে নিজের বাসায় ফিরে যাকেন। তখন শকুন্তলা চিঠি লিখে নিজের হাতে ডাক-বাক্সে ফেলে আসবেন। লোকাল চিঠি‌, কাল বেলা দশটা—এগারোটার সময় আমরা সে চিঠি পাব।’

কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না‌, চারটি মুণ্ড একত্রিত হইয়া রহিল। শেষে রতিকান্ত বলিল‌, ‘তাহলে আপনাদের মতে ডাক্তার পালিত অপরাধী নয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ডাক্তার পালিতও হতে পারে‌, এখনও কিছু বলা যায় না। আবার নর্মদাশঙ্করও হতে পারে। কাল নিশ্চয় জানা যাবে।’ বলিয়া সকালবেলা নর্মদাশঙ্করের বাড়িতে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল তাহা বিবৃত করিল।

শুনিয়া রতিকান্ত চুপ করিয়া রহিল। পাণ্ডেজি হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন‌, ‘আজ তাহলে ওঠা যাক। ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনারাও চলুন আমার বাসায়। রতিকান্ত‌, তুমিও চল‌, সবাই মিলে কেসটা আলোচনা করা যাবে। তুমি আজ সারাদিন ছিলে না‌, ইতিমধ্যে অনেক ব্যাপার ঘটেছে।’

0 Shares