বহ্নি-পতঙ্গ

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা কিন্তু আজ সকাল সকাল বাড়ি ফিরব। গিয়ী ভীষণ রেগে আছেন।’

আমরা বাহিরে আসিলাম। রতিকান্ত জমাদারকে ডাকিয়া পাহারা তুলিয়া লইতে বলিল।

বহ্নি ও পতঙ্গের কাহিনী শেষ হইয়া আসিতেছে। ভাবিয়া দেখিতে গেলে‌, এ কাহিনীর শেষ নাই‌, সারা সংসার জুড়িয়া আবহমান কাল এই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি চলিতেছে। কখনও পতঙ্গ তিল তিল করিয়া পুড়িয়া মরে‌, কখনও মুহুর্তমধ্যে ভস্মীভূত হইয়া যায়।

বাক্ষ্যমান বহ্নি ও পতঙ্গের খেলা শেষ হইয়া যাইবার পর আমি ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম‌, ‘আচ্ছা ব্যোমকেশ‌, এখানে পতঙ্গ কে? বহিস্থই বা কে?’

ব্যোমকেশ বলিয়াছিল‌, ‘দু’জনেই বহ্নি‌, দু’জনেই পতঙ্গ।’

কিন্তু থাক। পরের কথা আগে বলিয়া রাসভঙ্গ করিব না। সে-রাত্রে আটটা বাজিতেই ব্যোমকেশ ও আমি পাণ্ডেজির বাড়ি হইতে বাহির হইলাম; পাণ্ডেজি ও রতিকান্ত বসিয়া কেস সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিলেন। বক্সার হইতে রতিকান্ত কয়েদীর যে জবানবন্দী লিখিয়া আনিয়াছিল। তাহারই আলোচনা।

বাহিরে ঘুটফুটে অন্ধকার। রাস্তার ধারে আলো দু’ একটা আছে বটে। কিন্তু তাহা রাত্রির তিমির হরিবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। পাটনার পথঘাট ভাল চিনি না‌, এই অমাবস্যার রাত্রে চেষ্টা করিয়া কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানে পৌঁছিতে পারিব এ আশা সুদূরপরাহত। আমরা মনে মনে একটা দিক আন্দাজ করিয়া লইয়া হোচট খাইতে খাইতে চলিলাম। মনের এমন অগোছালো অবস্থা যে একটা বৈদ্যুতিক টর্চ আনিবার কাথাও মনে ছিল না। ভাগ্যক্রমে কিছুদূর যাইতে না যাইতে ঠুনঠুন ঝুনঝুন আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। একটা ধোঁয়াটে আলো মন্থর গতিতে আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। কাছে আসিলে একটি এক্কার আকৃতি অস্পষ্টভাবে রূপ পরিগ্রহ করিল। ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া হাঁকিল-‘দাঁড়া। ভাড়া যাবি?’

এক্কা দাঁড়াইল। আপাদমস্তক কম্বলে মোড়া এক্কাওয়ালার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম‌, না বাবু্‌, আমার ঘোড়া থকে আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশি দূর নয়‌, দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ি। যাবি তো চল‌, বকশিস পাবি।’

এক্কাওয়ালা বলিল‌, ‘আসুন বাবু্‌, আমার আস্তাবল ওই দিকেই।’

আমরা একার দুই পাশে পা ঝুলাইয়া বসিলাম। এক্কাওয়ালা চাবুক ঘুরাইয়া মুখে টকাস টকাস শব্দ করিল। ঘোড়া ঝন ঝন শব্দ করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।

১৪

দশ মিনিট পরে ব্যোমকেশ এক্কা থামাইতে বলিল। আমি এক্কা হইতে নামিয়া ধোঁয়াটে আলোয় ঠাহর করিয়া দেখিলাম‌, দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ির কোণে ডাক-বাক্সের নিকটে উপস্থিত হইয়াছি। ব্যোমকেশ এক্কাওয়ালাকে ভাড়া ও বিকশিস দিল।

‘সালাম বাবুজি।’

অন্ধকার-সমুদ্রে ভাসমান ধোঁয়াটে আলোর একটা বুদ্বুদ ঝুনঝুন শব্দ করিতে করিতে দূরে মিশাইয়া গেল। আমরা যে তিমিরে ছিলাম। সেই তিমিরে নিমজিত হইলাম।

‘এবার কী? দেশলাই জ্বালব?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার পূর্বেই চোখের উপর তীব্র আলো জ্বলিয়া উঠিল; হাত দিয়া চোখ আড়াল করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কে-সাব-ইন্সপেক্টর তিওয়ারী?

‘জি।’ তিওয়ারী টর্চের আলো মাটির দিকে নামাইয়া আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মাটি হইতে উত্থিত আলোর ক্ষীণ প্রতিভাস আমাদের তিনজনের মুখে পড়িল। সকলের.গায়ে কালো পোশাক‌, তিওয়ারীর কালো কোটের পিত্তলের বোতামগুলি চিকমিক করিতেছে।

‘আপনার সঙ্গে ক’জন আছে?’

‘দু’জন।’ বলিয়া তিওয়ারী আলো একটু পিছন দিকে ফিরাইল। দুইটি লিকলিকে প্রেত্যকৃতি পুলিস জমাদার তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া আছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ‌, দু’জনই যথেষ্ট! কি করতে হবে ওদের বলে দিয়েছেন?’

‘জি।’

‘তাহলে এবার একে একে গাছে ওঠা যাক। অজিত‌, তুমি সামনের গাছটাতে ওঠে। চুপটি করে গাছের ডালে বসে থাকবে‌, সিগারেট খাবে না। বাঁশীর আওয়াজ যতক্ষণ না শুনতে পাও ততক্ষণ গাছ থেকে নামবে না। —তিওয়ারীজি‌, টর্চটা আমাকে দিন।’

টর্চ লইয়া ব্যোমকেশ একটা আম গাছের উপর আলো ফেলিল। ডাক-বাক্স হইতে পাঁচ-ছয় হাত দূরে বেশ বড় আম গাছ‌, গুড়ির স্কন্ধ হইতে মোটা ডাল বাহির হইয়াছে। গাছে পিপড়ের বাসা আছে কিনা জল্পনা করিতে করিতে আমি গাছে উঠিয়া পড়িলাম।

‘ব্যস‌, আর উচুতে উঠে না।’ আমি দুইটা ডালের সন্ধিস্থলে সাবধানে বসিলাম। গাছে চড়িয়া লাফালাফি করার বয়স অনেক দিন চলিয়া গিয়াছে‌, একটু ভয়-ভয় করিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা। সব কথা মনে আছে তো?’

‘আছে। বাঁশী শুনলেই বিরহিণী রাধার মত ছুটব।’

ব্যোমকেশ তখন অন্য তিনজনকে লইয়া পাঁচিলের সমান্তরালে ভিতর দিকে চলিল। দুই তিনটা গাছ বাদ দিয়া আর একটা গাছে একজন জমাদার উঠিল। তারপর তাহারা আরও দূরে চলিয়া গেল‌, কে কোন গাছে উঠিল।’ দেখিতে পাইলাম না। ঘন পত্রান্তরাল হইতে কেবল সঞ্চরমান বৈদ্যুতিক টর্চের প্রভা চোখের সামনে খেলা করিতে লাগিল।

তারপর বৈদ্যুতিক টর্চও নিভিয়া গেল।

হাতের ঘড়ি চোখের কাছে আনিয়া রেডিয়াম-নির্দেশ লক্ষ্য করিলাম-নাটা বাজিয়া দশ মিনিট। অন্তত এক ঘণ্টার আগে কিছু ঘটিবে বলিয়া মনে হয় না।

বসিয়া আছি। ভাগ্যে বাতাস নাই‌, শীতের দাঁত তাই মমস্তিক কামড় দিতে পারিতেছে না। তবু থাকিয়া থাকিয়া হাড়-পাঁজরা কাঁপিয়া উঠিতেছে‌, দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হইয়া যাইতেছে।

আমবাগান সম্পূর্ণ নিঃশব্দ নয়। গাছের পাতাগুলো যেন উসখুসি করিতেছে‌, ফিসফিস করিয়া কথা বলিতেছে‌, অন্ধকারে শ্রবণ শক্তি তীক্ষ্ণ হইয়াছে তাই শুনিতে পাইতেছি। একবার মাথার উপর একটা পাখি-বোধহয় প্যাঁচা-চ্যাঁ চ্যাঁ শব্দ করিয়া উড়িয়া গেল‌, সম্ভবত গাছের মধ্যে আমাকে দেখিতে পাইয়াছে। চকিতে চোখ তুলিয়া দেখি গাছপালার ফাঁক দিয়া দুই চারিটি তারা দেখা যাইতেছে।

0 Shares