বহ্নি-পতঙ্গ

বসিয়া আছি। পৌঁনে দশটা বাজিল। সহসা সমস্ত ইন্দ্ৰিয় সজাগ হইয়া উঠিল। চোখে কিছু দেখিলাম না‌, কানেও কোনও শব্দ আসিল না‌, কেবল অনুভব করিলাম‌, আমার গাছের পাশ দিয়া কে যেন ভিতর দিকে চলিয়া গেল। কে চলিয়া গেল! পাণ্ডেজি! কিম্বা–!

একটা ভিজা-ভজা বাতাস আসিয়া মুখে লাগিল। ঊর্ধ্বে চাহিয়া দেখিলাম‌, তারাগুলি নিষ্প্রভ হইয়া আবার উজ্জ্বল হইল। বোধহয় কাল রাত্রির মত আকাশে কুয়াশা জমিতে আরম্ভ করিয়াছে।

হ্যাঁ‌, কুয়াশাই বটে। তারাগুলিকে আর দেখা যাইতেছে না। গাছের পাতায় কুয়াশা জমিয়া জল হইয়া নীচে টোপাইতেছে—চারিদিক হইতে মৃদু শব্দ উঠিল-টপ টপ টপ টপ!

প্রবল ইচ্ছা হইল। ধূমপান করি। দাঁতে দাঁত চাপিয়া ইচ্ছা দমন করিলাম…

ঘড়িতে সওয়া দশটা। আমি গাছের ডালের উপর খাড়া হইয়া বসিলাম। দীপনারায়ণের হাতার ভিতর যেন একটা গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল। তারপর একটা মোটর হাতা হইতে বাহির হইয়া বিপরীত দিকে চলিয়া গেল। গাড়ির হেডলাইটের ছটা কুয়াশার গায়ে ক্ষণেক তাল পাকাইল‌, তারপর আবার অন্ধকার।

বোধহয় মিস মান্না নিজের বাসায় ফিরিয়া গেলেন।

এইবার! দশ মিনিট স্নায়ু-পেশী শক্ত করিয়া বসিয়া রহিলাম‌, কিছুই ঘটিল না। তারপর হঠাৎ—খিড়কির দরজার দিকে দপ করিয়া আলো জ্বলিয়া উঠিল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পরস্পরায় তিন-চারবার পিস্তলের আওয়াজ হইল। পিস্তলের আওয়াজের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না‌, আমি মুহুর্তকাল নিশ্চল নিষ্পন্দ হইয়া গেলাম।

চমক ভাঙিল পুলিস হুইসলের তীব্র শব্দে। আমি গাছের ডাল হইতে নীচে লাফাইয়া পড়িলাম। মাটি কত দূরে তাহা ঠাহর করিতে পারি নাই‌, সারা গায়ে প্রবল ঝাঁকানি লাগিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিলাম খিড়কির কাছে গোটা ঠিকেই বলিয়া উঠিয়াছে। আমি সেই দিকে ছুটিলাম।

ছুটিতে ছুটিতে আর একবার পিস্তলের আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। তারপর পায়ে শিকড় লাগিয়া আছাড় খাইলাম। উঠিয়া আবার ছুটিলাম। হাত-পা অক্ষত আছে কিনা অনুভব করিবার সময় নাই। যেখানে আর সকলেই দাঁড়াইয়াছিল হুড়মুড় করিয়া সেখানে উপস্থিত হইলাম।

খিড়কি দরজার কাছে একটা স্থান ঘিরিয়া পাঁচজন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। পাণ্ডেজির হাতে রিভলবার‌, তিওয়ারী ও দুইজন জমাদারের হাতে টর্চ, ব্যোমকেশ কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া। তিনটি টর্চের আলো একই স্থানে পড়িয়াছে। পাঁচ জোড়া চক্ষুও সেই স্থানে নিবদ্ধ।

দুইটি মৃতদেহ মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছে; একজন স্ত্রীলোক‌, অন্যটি পুরুষ। স্ত্রীলোকটি শকুন্তলা‌, আর পুরুষ–রতিকান্ত।

রতিকান্তের নীল চক্ষু দুটা বিস্ময় বিস্ফারিত; ডান হাতের কাছে একটা পিস্তল পড়িয়া আছে‌, বাঁ হাতের আঙুলগুলা একটা সাদা রঙের খাম আঁকড়াইয়া আছে। শকুন্তলার মুখ ভাল দেখা যাইতেছে না। গায়ে কালো রঙের শাল জড়ানো। বুকের কাছে থোলো থোলো রক্ত-করবীর মত কাঁচা রক্ত।

ব্যোমকেশ নত হইয়া রতিকাস্তের আঙুলের ভিতর হইতে খামটা বাহির করিয়া লইয়া নিজের পকেটে পুরিল।

১৫

পাণ্ডেজির বাড়িতে নৈশ ভোজনের নিমন্ত্রণ। অতিথির সংখ্যা বাড়িয়াছে; ডাক্তার পালিত‌, মিস মান্না‌, ব্যোমকেশ ও আমি। টেবিল ঘিরিয়া খাইতে বসিয়াছি। আহার্য দ্রব্যের মধ্যে প্রধান–মুর্গীর কাশ্মীরী কোর্মা।

ব্যোমকেশ এক টুকরা মাংস মুখে দিয়া অর্ধ-নিমীলিত চক্ষে আস্বাদ গ্রহণ করিল‌, তারপর

পাণ্ডেজি হাসিমুখে ভ্রূ তুলিলেন‌, ‘কী চুরি করবেন?’

‘আপনার বাবুর্চিকে।’

পাণ্ডেজি হাসিতে লাগিলেন‌, বলিলেন‌, ‘অসম্ভব।’

‘অসম্ভব কেন?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘আমার বাবুর্চি আমি নিজেই।’

‘অ্যাঁ—এই অমৃত আপনি রেধেছেন। তবে আর আপনার পুলিসের চাকরি করার কি দরকার? একটি হোটেল খুলে বসুন‌, তিন দিনে লাল হয়ে যাবেন।’

কিছুক্ষণ হাস্য-পরিহাস চলিবার পর মিস মান্না বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আমাকে কিন্তু আপনারা ফাঁকি দিয়েছেন। সে হবে না‌, সব কথা আগাগোড়া বলতে হবে। কি করে কি হল সব বলুন‌, আমি শুনব।’

ডাক্তার পালিত বলিলেন‌, ‘আমিও শুনব। এ ক’দিন আমি আসামী। কিনা। এই ভাবনাতেই আধমরা হয়ে ছিলাম। এবার বলুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখন মুখ চলছে। খাওয়ার পর বলব।’

আকণ্ঠ আহার করিয়া আমরা বাহিরে আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ গড়গড়ার নল হাতে লইল‌, ডাক্তার পালিত একটি মোটা চুরুট ধরাইলেন।

মিস মান্না জব্দ মুখে দিয়া হাসিমুখে বলিলেন‌, ‘এবার আরম্ভ করুন।’

ব্যোমকেশ গড়গড়ার নিলে কয়েকটি মন্দ-মন্থর টান দিয়া ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল।

‘এই ঘরেই রতিকান্তকে প্রথম দেখেছিলাম। পাণ্ডেজিকে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল। সুন্দর চেহারা‌, নীল চোখ। দীপনারায়ণ সিং-এর উদ্দেশ্যে হাল্কা ব্যঙ্গ করে বলেছিল-বড় মানুষ কুটুম্ব। তখন জানতাম না। ওই হাল্কা ব্যঙ্গের আড়ালে কতখানি রিষ লুকিয়ে আছে। তখন কিছুই জানতাম না‌, তাই ‘কুটুম্ব’ কথাটাও কানে খোঁচা দিয়ে যায়নি। এখন অবশ্য জানতে পেরেছি শকুন্তলা আর রতিকান্তের মধ্যে একটা দূর সম্পর্ক ছিল; দু’জনেরই বাড়ি প্রতাপগড়ে‌, দু’জনেই পড়ে-যাওয়া ঘরানা ঘরের ছেলে মেয়ে‌, দু’জনে বাল্য প্রণয়ী।

‘রতিকান্ত সে-রাত্রে আমার পরিচয় জানতে পারেনি‌, পাণ্ডেজি কেবল বলেছিলেন,–আমার কলকাতার বন্ধু। তাতে তার মনে কোনও সন্দেহ হয়নি। যদি সে-রত্রে সে জানতে পারত যে অধমের নাম ব্যোমকেশ বক্সী তাহলে সে কি করত বলা যায় না‌, হয়তো প্ল্যান বদলে ফেলত। কিন্তু তার পক্ষে মুশকিল হয়েছিল। এই যে‌, পৌঁছুবার আর সময় ছিল না‌, একেবারে শিরে সংক্রান্তি এসে পড়েছিল।

0 Shares