বহ্নি-পতঙ্গ

‘শকুন্তলা আর রতিকান্তর গুপ্ত-প্রণয়ের অতীত ইতিহাস যত দূর আন্দাজ করা যায় তা এই। ওদের বিয়ের পথে সামাজিক বাধা ছিল‌, তাই ওদের দুরন্ত প্রবৃত্তি সমাজের চোখে ধুলো দিয়ে গুপ্ত-প্রণয়ে লিপ্ত হয়েছিল; ওদের উগ্ব অসংযত মন আধুনিক স্বৈরাচারের সুযোগ নিয়েছিল পূর্ণ মাত্রায়। কিন্তু তবু সবই চুপি চুপি। নৈতিক লজ্জা না থাক‌, লোকলজ্জার ভয় ছিল; তার উপর ‘চোরি পিরিতি লাখগুণ রঙ্গ’। লুকিয়ে প্রেম করার মধ্যে একটা তীব্র মাধুর্য আছে।

‘তারপর একদিন দীপনারায়ণ শকুন্তলাকে দেখে তার রূপ-যৌবনের ফাঁদে পড়ে গেলেন। শকুন্তলা দীপনারায়ণের বিপুল ঐশ্বর্য দেখল‌, সে লোভ সামলাতে পারল না। তাঁকে বিয়ে করল। কিন্তু রতিকান্তকেও ছাড়ল না। রতিকান্তর বিয়েতে মত ছিল কিনা আমরা জানি না। হয়তো পুরোপুরি ছিল না‌, কিন্তু শকুন্তলাকে ত্যাগ করাও তার অসাধ্য। শকুন্তলা বিয়ের পর যখন পাটনায় এল তখন রতিকান্তও যোগাড়যন্ত্র করে পাটনায় এসে বসল‌, বোধহয় মোহান্ধ দীপনারায়ণ সাহায্য করেছিলেন। ফলে ভিতরে ভিতরে আবার রতিকান্তর আর শকুন্তলার আগের সম্বন্ধ বজায় রইল। বিয়েটা হয়ে রইল ধোঁকার টাটি।’

‘কুটুম্ব হিসাবে রতিকান্ত দীপনারায়ণের বাড়িতে যাতায়াত করত‌, কিন্তু প্রকাশ্যে শকুন্তলার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখাত না। তাদের সত্যিকারের দেখা সাক্ষাৎ হত সকলের চোখের আড়ালে। শকুন্তলা চিঠি লিখে গভীর রাত্রে নিজের হাতে ডাক-বাক্সে ফেলে আসত; রতিকান্ত নির্দিষ্ট রাত্রে আসত‌, খিড়কির দরজা দিয়ে হাতায় ঢুকত‌, তারপর লোহার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেত। শকুন্তলা দোর খুলে প্রতীক্ষা করে থাকত–

‘এইভাবে চলছিল‌, হঠাৎ প্রকৃতিদেবী বাদ সাধলেন। দীপনারায়াণের যখন গুরুতর অসুখ ঠিক সেই সময় শকুন্তলা জানতে পারল সে অন্তঃসত্ত্বা। এখন উপায়? অন্য সকলের চোখে যদি বা ধুলো দেওয়া যায়‌, দীপনারায়ণের চোখে ধুলো দেওয়া যায় না। দু’জনে মিলে পরামর্শ করল তাড়াতাড়ি দীপনারায়ণকে সরাতে হবে; নইলে মান-ইজ্জত রাজ-ঐশ্বৰ্য কিছুই থাকবে না‌, গালে চুন কালি মেখে ভদ্রসমাজ থেকে বিদায় নিতে হবে।

‘মৃত্যু ঘটাবার এই চোস্ত ফন্দিটা রতিকাস্তের মাথা থেকে বেরিয়েছিল সন্দেহ নেই। দৈব যোগাযোগও ছিল; এক শিশি কিউরারি একটা ছিচকে চোরের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। সেটা যখন রতিকান্তর হাতে এল‌, রতিকান্ত প্রথমেই খানিকটা কিউরারি সরিয়ে ফেলল। তারপর যথাসময়-রতিকান্ত নিজেই ডাক্তারবাবুর ডিসপেনসারির তালা ভেঙে লিভারের ভায়াল বদলে রেখে এল‌, তারপর নিমন্ত্রণ-বাড়িতে গিয়ে খবর দিলে। সকলেই ভাবলে ছিচকে চোরের কাজ।

‘সেই রাত্রেই রতিকান্ত আমার নাম জানতে পারল। অনুবাদের কল্যাণে হিন্দী শিক্ষিত সমাজে আমার নামটা অপরিচিত নয়। রতিকান্ত ঘাবড়ে গেল। কিন্তু তখন আর উপায় নেই‌, হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেছে।

‘পরদিন সকালে ডাক্তারবাবু ইনজেকশন দিলেন‌, দীপনারায়ণের মৃত্যু হল। রতিকান্ত ভেবেছিল‌, কিউরারি বিষের কথা কারুর মনে আসবে না‌, সবাই ভাববে লিভার ইনজেকশনের শকে মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারবাবুও প্রথমে তাই ভেবেছিলেন‌, কিন্তু যখন কিউরারির কথা উঠল। তখন তাঁর খটকা লাগিল। তিনি বললেন,–হতেও পারে।

‘রতিকান্ত আগে থাকতে ঘাবড়ে ছিল‌, এখন সে আরও ঘাবড়ে গিয়ে একটা ভুল করে ফেললে। এই বোধহয় তার একমাত্র ভুল। সে ভাবল‌, দীপনারায়ণের শরীরে নিশ্চয় কিউরারি পাওয়া যাবে; এখন যদি লিভারের ভায়ালে কিউরারি না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের সন্দেহ হবে ডাক্তার পালিতাই ভায়াল বদলে দিয়েছেন। রতিকাম্ভের কাছে একটা নির্বিষ লিভারের ভায়াল ছিল‌, যেটা সে ডাক্তার পালিতের ব্যাগ থেকে বদলে নিয়েছিল। সে অ্যানালিসিসের জন্যে সেই নির্বিষ ভায়ালটা পাঠিয়ে দিলে।

‘যখন জানা গেল ভায়ালে বিষ নেই তখন ভারি ধোঁকা লাগল। শরীরে বিষ পাওয়া গেছে অথচ ওষুধে বিষ পাওয়া গেল না‌, এ কি রকম? দীপনারায়ণের মৃত্যুর পর কেবল তিনজনের হাতে ভায়ালটা গিয়েছিল-ডাক্তার পালিত‌, পাণ্ডেজি আর রতিকান্ত। পাণ্ডেজি আর রীতিকান্ত পুলিসের লোক; সুতরাং ডাক্তারবাবুরই কাজ‌, তিনি এই রকম একটা গোলমেলে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে পুলিসের মাথা গুলিয়ে দিতে চান। কিন্তু ডাক্তার পালিতের মোটিভ কি?

‘ইতিমধ্যে দুটো মোটিভ পাওয়া গিয়েছিল-টাকা আর গুপ্ত-প্রেম। গুপ্ত-প্রেমের সন্দেহটা ডাক্তার পালিতাই আমাদের মনে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যদি গুপ্ত-প্ৰেমই আসল মোটিভ হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে‌, শকুন্তলার দুষ্মন্ত কে? আর যদি টাকা মোটিভ হয় তাহলে তিনজনের ওপর সন্দেহ-দেবনারায়ণ‌, চাঁদনী আর গঙ্গাধর বংশী। শকুন্তলাও কলঙ্ক এড়াবার জন্যে লোক লাগিয়ে স্বামীকে খুন করতে পারে। এদের মধ্যে যে-কেউ ডাক্তার পালিতকে মোটা টাকা খাইয়ে নিজের কাজ হাসিল করে থাকতে পারে। একুনে সন্দেহভাজনের সংখ্যা খুব কম হল না; দেবনারায়ণ থেকে নর্মদাশঙ্কর‌, ঘোড়া জগন্নাথ সকলেরই কিছু না কিছু স্বাৰ্থ আছে।

‘রতিকান্ত কিন্তু উঠে-পড়ে লেগেছিল দোষটা ডাক্তার পালিতের ঘাড়ে চাপাবে। সে বক্সারে গিয়ে কয়েদীর কাছ থেকে জবানবন্দী লিখিয়ে নিয়ে এল। আমরা জানি এ-ধরনের কয়েদীকে হুমকি দিয়ে বা লোভ দেখিয়ে পুলিস যে-কোনও জবানবন্দী আদায় করতে পারে। তাই আমরা কুলগুলির মতলব বলে মেন মনে হাসলাম। রফিকাই যে অপরাধী তা আমরা তখন জানতে পেরেছি।

‘অন্যদিকে ছোটখাটো দু’ একটা ব্যাপার ঘটছিল। পিতা-পুত্র গঙ্গাধর আর লীলাধর মিলে বারো হাজার টাকা হজম করবার তালে ছিল। ওদিকে নর্মদাশঙ্কর দীপনারায়ণের মৃত্যুতে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল‌, ভেবেছিল শকুন্তলার হৃদয়ের শূন্য সিংহাসন সেই এবার দখল করবে। সে জানত না যে শকুন্তলার হৃদয়-সিংহাসন কোনওকালেই শূন্য হয়নি।

0 Shares