বহ্নি-পতঙ্গ

‘হঠাৎ সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল‌, শকুন্তলার দুষ্মন্ত কে তা জানতে পারলাম। শকুন্তলা দেয়ালে একটা ছবি এঁকেছিল। সেকালে শকুন্তলার পূর্বরাগের ছবি। প্রথম যে-রাত্রে ছবিটা দেখি সে-রত্রে কিছু বুঝতে পারিনি‌, নীল আলোয় ছবির নীল-রঙ চাপা পড়ে গিয়েছিল। পরদিন দিনের আলোয় যখন ছবিটা দেখলাম এক মুহুর্তে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। যেন কুয়াশায় মুক্তি ঝাপসা হয়ে ছিল‌, হঠাৎ কুয়াশ খুঁড়ে সূর্ব বেরিয়ে এল। ছবিতে দুষ্মন্তের চোখের মণি নীল।

‘প্ৰেম বড় মারাত্মক জিনিস। প্রেমের স্বভাব হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা‌, ব্যক্ত করা‌, সকলকে ডেকে জানানো-আমি ওকে ভালবাসি। অবৈধ প্ৰেম তাই আরও মারাত্মক! যেখানে পাঁচজনের কাছে প্ৰেম ব্যক্ত করবার উপায় নেই। সেখানে মনের কথা বিচিত্র ছদ্মবেশে আত্মপ্রকাশ করে।‘ শকুন্তলা ছবি এঁকে নিজের প্রেমকে ব্যক্ত করতে চেয়েছিল। ছবিতে দুষ্মন্তের চেহারা মোটেই রতিকান্তের মত নয়‌, কিন্তু তার চোখের মণি নীল। ‘বুঝ লোক যে জান সন্ধান!’ অজিত আর পাণ্ডেজিও ছবি দেখেছিলেন‌, কিন্তু তাঁরা নীলচোখের ইশারা ধরতে পারেননি।

‘এই ব্যাপারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত লোক আছে তাদের মধ্যে কেবল রতিকান্তরই নীল চোখ। সুতরাং রতিকান্তাই শকুন্তলার প্রচ্ছন্ন প্রেমিক। মোটিভ এবং সুযোগ‌, বুদ্ধি এবং কর্মতৎপরতা সব দিক দিয়েই সে ছাড়া আর কেউ দীপনারায়ণের মৃত্যুর জন্যে দায়ী নয়।

‘কিন্তু তাকে ধরব কি করে? শুধু নীল-চোখের প্রমাণ যথেষ্ট নয়। একমাত্র উপায়‌, যদি ওরা নিভৃতে পরস্পর দেখা করে‌, যদি ওদের এমন অবস্থায় ধরতে পারি যে অস্বীকার করবার পথ না থাকে।

‘ফাঁদ পাতলাম। আমি একা শকুন্তলার সঙ্গে দেখা করে স্পষ্ট ভাষায় বললাম-তোমার দুষ্মন্ত কে তা আমি জানতে পেরেছি এবং সে কি করে দীপনারায়ণকে খুন করেছে তাও প্রমাণ দিতে পারি। কিন্তু আমি পুলিস নয়; তুমি যদি আমাকে এক লাখ টাকা দাও। তাহলে আমি তোমাদের পুলিসে ধরিয়ে দেব না। আর যদি না দাও পুলিসে সব কথা জানতে পারবে। বিচারে তোমাদের দু’জনেরই ফাঁসি হবে। শকুন্তলা কিছুঁতেই স্বীকার করে না। কিন্তু দেখলাম ভয় পেয়েছে। তখন বললাম-তোমাকে আজকের দিনটা ভেবে দেখবার সময় দিলাম। যদি এক লাখ টাকা দিয়ে আমার মুখ বন্ধু করতে রাজী থাকে‌, তাহলে আজ রাত্রে আমার নামে একটা চিঠি লিখে‌, নিজের হাতে ডাক-বাক্সে দিয়ে আসবে। চিঠিতে স্রেফ একটি কথা লেখা থাকবে-হাঁ। রাত্রি দশটার পর মিস মান্নাকে এখান থেকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা আমি করব‌, রাত্ৰে হাতায় পুলিস পুহারাও থাকবে না। যদি কাল তোমার চিঠি না পাই‌, আমার সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাণ্ডেজির হাতে সমর্পণ করব।

‘ভয়-ব্বিৰ্ণ শকুন্তলাকে রেখে আমি চলে এলাম‌, মিস মান্না তার ভার নিলেন। এখন শুধু নজর রাখতে হবে শকুন্তলা আড়ালে রতিকান্তের সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ না পায়। তারপর আমি পাণ্ডেজির সঙ্গে পরামর্শ করে বাকি ব্যবস্থা ঠিক করলাম। রাত্রে রতিকান্ত বক্সার থেকে ফিরলে তাকে এক নতুন গল্প শোনালাম‌, তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে পাণ্ডেজির এখানে এলাম।

‘আমি আর অজিত সকাল সকাল এখান থেকে বেরিয়ে দীপনারায়ণের বাড়ির পাশে আমবাগানে গেলাম; তিওয়ারী দু’জন লোক নিয়ে উপস্থিত ছিল‌, সবাই আম গাছে উঠে লুকিয়ে রইলাম। এদিকে পাণ্ডেজি রাত্রি সাড়ে নটা পর্যন্ত রতিকান্তকে আটকে রেখে ছেড়ে দিলেন‌, আর নিজে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। অন্ধকারে গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষ্ণ আরম্ভ হল।

‘আমি ছিলাম। খিড়কির দরজার কাছেই একটা গাছে। পাণ্ডেজি এসে আমার পাশের গাছে উঠেছিলেন। নিঃশব্দ অন্ধকারে ছয়টি প্রাণী বসে আছি। দশটা বাজল। আকাশে কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছিল; গাছের পাতা থেকে টপ টপ শব্দে জল পড়তে লাগল। তারপর মিস। মান্না মোটরে বাড়ি চলে গেলেন।

‘রতিকান্ত কখন এসেছিল। আমরা জানতে পারিনি। সে বোধ হয় একটু দেরি করে এসেছিল; পাণ্ডেজির কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে সে নিজের বাসায় গিয়েছিল‌, সেখান থেকে পিস্তল নিয়ে আমবাগানে এসেছিল।

‘রতিকান্তের চরিত্র আমরা একটু ভুল বুঝেছিলাম—যেখানেই দেখা যায় দু’জন বা পাঁচজন একজোট হয়ে কাজ করছে সেখানেই একজন সদর থাকে‌, বাকি সকলে তার সহকারী। বর্তমান ক্ষেত্রে আমরা ভেবেছিলাম শকুন্তলাই নাটের গুরু‌, রতিকান্ত সহকারী। আসলে কিন্তু ঠিক তার উল্টো। রতিকান্তের মনটা ছিল হিংস্ব শ্বাপদের মত‌, নিজের প্রয়োজনের সামনে কোনও বাধাই সে মানত না। সে যখন শুনল যে শকুন্তলা চিঠি লিখে অপরাধীর নাম প্রকাশ করে দিতে রাজী হয়েছে তখনই সে স্থির করল শকুন্তলাকে শেষ করবে। তার কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে প্রেম বড় নয়।

‘আমরা ভেবেছিলাম রতিকান্ত শকুন্তলাকে বোঝাতে আসবে যে শকুন্তলা যদি অপরাধীর নাম প্রকাশ না করে তাহলে কেউ তাদের ধরতে পারবে না‌, শাস্তি দিতেও পারবে না। আমাদের প্ল্যান ছিল‌, যে-সময় ওরা এই সব কথা বলাবলি করবে। ঠিক সেই সময় ওদের ধরব।

‘রতিকান্ত কিন্তু সে—ধার দিয়ে গেল না। সে মনে মনে সঙ্কল্প করেছিল অনিষ্ট্রের জড় রাখবে না‌, সমুলে নির্মূল করে দেবে।

শকুন্তলা কখন চিঠি হাতে নিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরুল আমরা জানতে পারিনি, চারিদিকের টপ টপ শব্দের মধ্যে তার পায়ের আওয়াজ ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু রতিকান্ত বোধহয় দোরের পাশেই ওৎ পেতে ছিল‌, সে ঠিক শুনতে পেয়েছিল। হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে দপ করে টর্চ জ্বলে উঠল‌, সেই আলোতে শকুন্তলার ভয়ার্তা মুখ দেখতে পেলাম। ওদের মধ্যে কথা হল না‌, কেবল কয়েকবার পিস্তলের আওয়াজ হল। শকুন্তলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

0 Shares