ব্যোমকেশ একবার আমার দিকে তাকাইল, বলিল, ‘মন্দ কি! একটা নূতনত্ব হবে। আপনার কাশ্মীরী কোমা না হয়। আপাতত ধামাচাপা রইল।’
পাণ্ডেজি হাসিয়া টেলিফোনের মধ্যে বলিলেন, ‘বেশ, ওঁরা যাবেন…ওঁদের কার্ড আমার কাছেই পাঠিয়ে দেবেন…আচ্ছা, কাল আবার দেখা হবে। নমস্তে।’
পাণ্ডেজি টেলিফোন রাখিয়া বলিলেন, ‘চলুন, এবার আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।’
২
পরদিন সন্ধ্যা আন্দাজ সাতটার সময় পাণ্ডেজি আসিয়া আমাদের মোটরে তুলিয়া দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে লইয়া গেলেন।
দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ি শহরের প্রাচীন অংশে। সাবেক কালের বিরাট দ্বিতল বাড়ি, জেলখানার মত উচু প্রাচীর দিয়া ঘেরা। আমরা উপস্থিত হইয়া দেখিলাম বাড়ি ও বাগানে জাপানী ফানুসের ঝাড় জ্বলিতেছে, অতি মৃদু শান্নাই বাজিতেছে, বহু অতিথির সমাগম হইয়াছে। একতলার বড় হল-ঘরটিতেই সমাগম বেশি, আশেপাশের ঘরগুলিতেও অতিথিরা বসিয়াছেন। কোনও ঘরে ব্রিজের আড্ডা বসিয়াছে, কোনও ঘরে বয়স্থ হাকিম শ্রেণীর অতিথিরা নিজেদের মধ্যে একটু স্বতন্ত্র গণ্ডী রচনা করিয়া গল্পগুজব করিতেছেন। তকমা আটা ভূত্যেরা চা, কফি ও বলবত্তর পানীয় লইয়া ঘোরাঘুরি করিতেছে।
হল-ঘরটি বৃহৎ, বিলাতি প্রথায় স্থানে স্থানে সোফা-সেট দিয়া সজ্জিত। প্রত্যেক সোফা-সেটে একটি দল বসিয়াছে। ঘরের মধ্যস্থলে সদর দরজার সম্মুখে একটি পালঙ্কের মত আসন। তাহার উপর তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া আছেন একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, ইনিই গৃহস্বামী দীপনারায়ণ সিং। গায়ে লম্বা গরম কোট, গলায় পশমের গলাবন্ধ। চেহারা ভাল, পঞ্চাশ বছর বয়সে এমন কিছু স্থবির হইয়া পড়েন নাই, কিন্তু মুখের পাণ্ডুর শীর্ণত হইতে অনুমান করা যায় দীর্ঘ রোগ-ভোগ করিয়া সম্প্রতি আরোগ্যের পথে পদার্পণ করিয়াছেন। পরম সমাদরে দুই হাতে আমাদের করমর্দন করিলেন।
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আপনার রোগমুক্তির জন্য অভিনন্দন জানাই।’
দীপনারায়ণ শীর্ণ মুখে মিষ্ট হাসিলেন, ‘বহুৎ ধন্যবাদ। বাঁচবার আশা ছিল না পাণ্ডেজি, নেহাৎ ডাক্তার পালিত ছিলেন তাই এ যাত্রা বেঁচে গেছি।’ বলিয়া ঘরের কোণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
ঘরের কোণে একটি সোফায় কোট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক একাকী বসিয়া ছিলেন; দোহারা গড়ন, বেশভুষার বিশেষ পারিপাট্য নাই, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। অঙ্গুলি নির্দেশ লক্ষ্য করিয়া তিনি আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। পরিচয় হইল। দীপনারায়ণ সিং বলিলেন, ‘এঁরই গুণে আমার পুনর্জন্ম হয়েছে।’
ডাক্তার পালিত যেন একটু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন। তিনি গভীর প্রকৃতির লোক, একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘ডাক্তারের যা কর্তব্য তার বেশি তো কিছুই করিনি।–তাছাড়া, চিকিৎসা আমি করলেও শহরের বড় বড় ডাক্তার সকলেই দেখেছেন। ত্রিদিববাবু—‘
পাণ্ডেজি প্রশ্ন করিলেন, ‘রোগটা কি হয়েছিল?’
ডাক্তার পালিত বিলাতি নিদানশাস্ত্র সম্মত রোগের যে সকল লক্ষণ বলিলেন তাহা হইতে অনুমান করিলাম, নানা জাতীয় দুষ্ট বীজাণু লিভারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া রক্তাল্পতা ঘটাইয়াছিল এবং হৃদপিণ্ডকে জখম করিবার তালে ছিল, ইনজেকশন প্রভৃতি আসুরিক চিকিৎসার দ্বারা তাহাদের বশে আনিতে হইয়াছে। এখন অবশ্য রোগীর অবস্থা খুবই ভাল, তবু তাঁহার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইয়াছে।
এই সময় পিছন দিকে নাক ঝাড়ার মত একটা শব্দ শুনিয়া চমকিয়া ফিরিয়া দেখি, একটি যুবক আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং নাকের মধ্যে শব্দ করিয়া বোধকরি উপেক্ষা জ্ঞাপন করিতেছে। যুবকের চেহারা কৃকলাসের মত, অঙ্গে ফ্যাশন-দূরস্ত বিলাতি সাজপোশাক, মুখে ব্যঙ্গ দম্ভ। দীপনারায়ণ পরিচয় করাইয়া দিলেন-ইনি ডাক্তার জগন্নাথ প্রসাদ, একজন নবীন বিহারী ডাক্তার।’ ডাক্তার অবজ্ঞােভরে আমাদের দিকে ঘাড় নাড়িলেন এবং যে কয়টি কথা বলিলেন তাহা হইতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, প্রবীণ ডাক্তারদের প্রতি তাঁহার অশ্রদ্ধার অন্ত নাই, বিশেষত যদি তাঁহারা বাঙালী ডাক্তার হন। দীপনারায়ণ সিং-এর চিকিৎসার ভার কয়েকজন বুড়া বাঙালী ডাক্তারকে না দিয়া তাঁহার হাতে অৰ্পণ করিলে তিনি পাঁচ দিনে রোগ আরাম করিয়া দিতেন। তাঁহার কথা শুনিয়া দীপনারায়ণ সিং মুখ বাঁকাইয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। ডাক্তার পালিত বিরক্ত হইয়া আবার পূর্বস্থানে গিয়া বসিলেন। ডাক্তার জগন্নাথ আরও কিছুক্ষণ বক্তৃতা দিয়া, অদূরে পানীয়বাহী একজন ভৃত্যকে দেখিয়া হেষাধবনি করিতে করিতে সেইদিকে ধাবিত হইলেন।
দীপনারায়ণ সিং লজ্জা ও ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে বলিলেন, ‘এরাই হচ্ছে নতুন যুগের বিহারী। এদের কাছে গুণের আদর নেই, সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে এরা শুধু নিজের সুবিধা করে নিতে চায়। আজ বিহারে বাঙালীর কদর কমে যাচ্ছে, এরাই তার জন্যে দায়ী।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হয়তো বাঙালীরও দোষ আছে।’
দীপনারায়ণ বলিলেন, ‘হয়তো আছে। কিন্তু পরিহাস এই যে, এরা যখন রোগে পড়ে, যখন প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়, তখন এরাই ছুটে যায় বাঙালী ডাক্তারের কাছে।’
এই অপ্রীতিকর প্রাদেশিক প্রসঙ্গ উঠিয়া পড়ায় আমরা একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িতেছিলাম, কিন্তু পাণ্ডেজি তাহা সরল করিয়া দিলেন, দুই চারিটা অন্য কথা বলিয়া আমাদের লইয়া গিয়া যেখানে ডাক্তার পালিত বসিয়া ছিলেন। সেইখানে বসাইলেন।
আমরা উপবিষ্ট হইলে ডাক্তার পালিত একটু অল্প হাসিয়া বলিলেন, ‘ঘোড়া জগন্নাথ আর কি কি বলল?’