বহ্নি-পতঙ্গ

পাণ্ডেজি হাসিয়া উঠিলেন‌, ‘ওর নাম বুঝি ঘোড়া জগন্নাথ? খাসা নাম‌, ভারি লগ-সৈ হয়েছে। কিন্তু ওদের কথায় আপনি কান দেবেন না ডাক্তার। ওদের কথা কে গ্রাহ্য করে?’

পালিত বলিলেন‌, ‘কান না দিয়ে উপায় কি? ওরা যে দল বেঁধে প্রচার কার্য করে বেড়াচ্ছে। যারা বুদ্ধিমান তারা হয়তো গ্রাহ্য করে না‌, কিন্তু সাধারণ লোকে ওদের কথাই শোনে।’

আমাদের আলোচনা হয়তো আর কিছুক্ষণ চলিত কিন্তু হঠাৎ পাশের দিকে একটা অদ্ভুত ধরনের হাসির শব্দে তাহাতে বাধা পড়িল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখি‌, অদূরে অন্য একটি সোফা-সেটে তিনটি লোক আসিয়া বসিয়াছে; তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি উচ্চকণ্ঠে হাস্য করিতেছে তাহার দেহায়তন এতাই বিপুল যে সে একই সমস্ত সোফাটি জুড়িয়া বসিয়াছে। বুঢ়োরস্ক গজস্কন্ধ যুবক‌, চিবুক হইতে নিতম্ব পর্যন্ত থরে থরে চর্বির তরঙ্গ নামিয়াছে। তাহার কণ্ঠ হইতে যে বিচিত্র হাস্যধ্বনি নিৰ্গত হইতেছে তাহা যে একই কালে একই মানুষের কণ্ঠ হইতে বাহির হইতে পারে তাহা প্রত্যক্ষ না করিলে বিশ্বাস করা কঠিন। একসঙ্গে যদি গোটা দশেক শৃগাল হুক্কাহুয়া করিয়া ডাকিয়া ওঠে এবং সেই সঙ্গে কয়েকটা পেচোয় পাওয়া আতুড়ে ছেলে কান্না জুড়িয়া দেয় তাহ হইলে বোধহয় এই শব্দ-সংগ্রামের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

অন্য লোক দু’টি নীরবে বসিয়া মুচকি হাসিতেছিল। আশ্চর্য এই যে মোটা যুবকটি যে-পরিমাণে মোটা‌, তাহার সঙ্গী দু’টি ঠিক সেই পরিমাণে রোগা। ইহাদের তিনজনের দেহের মেদ মাংস সমানভাবে বাঁটিয়া দিলে বোধকরি তিনটি হৃষ্টপুষ্ট সাধারণ মানুষ পাওয়া যায়।

বলা বাহুল্য হাসির এই অট্টরোলে ঘরসুদ্ধ লোকের সচকিত দৃষ্টি সেইদিকে ফিরিয়াছিল। একটি রেশমী পাগড়ি-পরা কৃশকায় বৃদ্ধ কোথা হইতে আবির্ভূত হইয়া দ্রুত সেইদিকে অগ্রসর হইলেন।

ব্যোমকেশ ডাক্তার পালিতকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘গজকচ্ছপটি কে?’

ডাক্তার পালিত মুখ টিপিয়া বলিলেন‌, ‘দীপনারায়ণবাবুর ভাইপো দেবনারায়ণ। একটি আস্ত—’ কথাটা ডাক্তার শেষ করিলেন না‌, কিন্তু তাঁহার অনুচ্চারিত বিশেষ্যটি স্পষ্টই বোঝা গেল। ইহাকেই উদ্দেশ্য করিয়া কাল পাণ্ডেজি বলিয়াছিলেন-ঘোর অপদার্থ। শুধু অপদার্থই নয়‌, বুদ্ধিসুদ্ধিও শরীরের অনুরূপ। পাগড়ি-পরা বৃদ্ধটি আসিয়া রোগা যুবক দু’টিকে কানে কানে কিছু বলিলেন‌, মনে হইল তিনি তাঁহাদের মৃদু ভর্ৎসনা করিলেন। রোগা লোক দু’টিও যেন অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়াছে এইভাবে ভিজা বিড়ালের মত চক্ষু নত করিয়া রহিল। গজকচ্ছপের হাসি তখনও থামে নাই‌, তবে মন্দীভূত হইয়া আসিয়াছে। বৃদ্ধ তাহার পিছনে গিয়া দাঁড়াইলেন এবং কানের কাছে নত হইয়া কিছু বলিলেন। হঠাৎ ব্রেককষা গাড়ির মত গজকচ্ছপের হাসি হেঁচকা দিয়া থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ পূর্ববৎ ডাক্তার পালিতকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘রোগ লোক দু’টি কে?’

পালিত বলিলেন‌, ‘ওই যেটির কোঁকড়া চুল কাঁকড়া গোঁফ ও হচ্ছে দেবনারায়ণের বিদূষক‌, মানে ইয়ার। নাম বেণীপ্রসাদ। অন্যটির নাম লীলাধর বংশী-দীপনারায়ণবাবুর স্টেটের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার এবং দেবনারায়ণের অ্যাসিসট্যান্ট বিদূষক।’

‘আর বৃদ্ধটি?’

‘বৃদ্ধটি লীলাধরের বাবা গঙ্গাধর বংশী‌, স্টেটের বড় কর্তা‌, অৰ্থাৎ ম্যানেজার। গভীর জলের মাছ।’

গভীর জলের মাছটি একবার চক্ষু তুলিয়া আমাদের পানে চাহিলেন এবং মন্দমধুর হাস্যে আমাদের অভিসিঞ্চিত করিয়া অন্যত্ব প্রস্থান করিলেন। দেবনারায়ণ নিজ ঝকমকে শার্কস্কিনের গলাবন্ধ কোটের পকেট হইতে একটি সুবৃহৎ পানের ডিবা বাহির করিয়া কয়েকটা পান গালে পুরিয়া গুরু গম্ভীর মুখে চিবাইতে লাগিল। এই লোকটাই কিছুক্ষণ পূর্বে হট্টগোল করিয়া হাসিতেছিল। তাহা আর বোঝা যায় না।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘হাসির কারণটা কী কিছু বুঝতে পারলেন?’

পালিত বলিলেন‌, ‘বোধহয় বিদূষকেরা রসের কথা কিছু বলেছিল তাই এত হাসি।’

একজন ভৃত্য রূপার থালায় সোনালী তবক মোড়া পান ও সিগারেট লইয়া উপস্থিত হইল। আমরা সিগারেট ধরাইলাম। ব্যোমকেশ এদিকে ওদিকে চাহিয়া পাণ্ডেজিকে বলিল‌, ‘ইন্সপেক্টর রতিকান্তকে দেখছি না।’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘হয়তো অন্য ঘরে আছে। কিম্বা হয়তো থানায় আটকে গেছে। আসবে। নিশ্চয়। আপনারা বসুন‌, আমি একবার কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি।’

পাণ্ডেজি উঠিয়া গেলেন। আমরা তিনজনে বসিয়া সিগারেট টানিতে টানিতে ঘরের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অতিথিগুলিকে দর্শন করিতে লাগিলাম। অতিথিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি‌, দু’ একটি স্ত্রীলোক আছেন।

এই সময় ঘরের অন্য প্ৰান্তের একটি দ্বারা দিয়া এক মহিলা প্রবেশ করিলেন। ঘরে বেশ উজ্জ্বল আলো ছিল‌, এখন মনে হইল কেবলমাত্র এই মহিলাটির আবিভাবে ঘরটি উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। তিনি কোন রঙের শাড়ি পরিয়াছেন‌, কী কী গহনা পরিয়াছেন কিছুই চোখে পড়িল না‌, কেবল দেখিলাম‌, আলোকের একটি সঞ্চরমাণ উৎস ধীরে ধীরে আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। ঘরের মধ্যে যাঁহারা ছিলেন সকলেই সচকিত হইয়া উঠিলেন‌, কেহ কেহ উঠিয়া দাঁড়াইয়া নমস্কার করিলেন। মহিলাটি হাসিমুখে লীলায়িত ভঙ্গিমায় সকলকে অভ্যর্থনা করিতে করিতে আমাদের দিকেই আসিতে লাগিলেন।

ডাক্তার পালিত অ্যাশ-ট্রের উপর সিগারেট ঘসিয়া নিভাইলেন‌, মৃদুস্বরে বলিলেন‌, ‘মিসেস দীপনারায়ণ–শকুন্তলা।’

রূপসী বটে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের কম হইবে না‌, কিন্তু সবাঙ্গে পরিপূর্ণ যৌবনের মদৌদ্ধত লাবণ্য যেন ফাটিয়া‌, পড়িতেছে। আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এইরূপ লাবণ্যবতী। তপ্তকাঞ্চনবর্ণ রমণী হয়তো দুই চারিটি দেখা যায়‌, কিন্তু এদিকে বেশি দেখা যায় না। শকুন্তলা নামটিও যেন রূপের সঙ্গে ছন্দ রক্ষা করিয়াছে। শকুন্তলা–অন্সর কন্যা শকুন্তলা-যাহাকে দেখিয়া দুষ্মন্ত ভুলিয়াছিলেন। দীপনারায়ণ সিং প্রৌঢ় বয়সে কোন অসবর্ণ বিবাহ করিয়াছেন তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না।

0 Shares