শকুন্তলা আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, আমরা সসম্রামে গাত্ৰোত্থান করিলাম। ডাক্তার পালিত পরিচয় করাইয়া দিলেন। শকুন্তলা অতি মিষ্ট স্বরে দুই চারিটি সাদর সম্ভাষণের কথা বলিলেন, তাহাতে তাঁহার গৃহিণীসুলভ সৌজন্য এবং তরুণীসুলভ শালীনতা দুইই প্রকাশ পাইল। তারপর তিনি অন্যদিকে ফিরিলেন।
এই সময় লক্ষ্য করিলাম শকুন্তলা একা নয়, তাঁহার পিছনে আর একটি যুবতী রহিয়াছেন। সূর্যের প্রভায় যেমন শুকতারা ঢাকা পড়িয়া যায়, এতক্ষণ এই যুবতী তেমনি ঢাকা পড়িয়া ছিলেন; এখন দেখিলাম তাঁহার কোলে একটি বছর দেড়েকের ছেলে। বস্তুত এই ছেলেটি হঠাৎ ট্যাঁ, করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়াই যুবতীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। যুবতী শকুন্তলার চেয়ে বোধহয় দু’ এক বছরের ছোটই হইবেন; সুশ্ৰী গৌরাঙ্গী, মোটাসোটা টিলাঢালা গড়ন, মহাৰ্ঘ বস্ত্ব ও গহনার ভারে যেন নড়িতে পারিতেছেন না। তাঁহার বেশবাসের মধ্যে প্রাচুর্য আছে। কিন্তু নিপুণতা নাই। তাছাড়া মনে হয় প্রকাশ্যভাবে পাঁচজন পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করিতে তিনি অভ্যস্ত নন, পদার ঘোর এখনও কাটে নাই।
শিশু কাঁদিয়া উঠিতেই শকুন্তলা পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। তাঁহার মুখে একটু অপ্রসন্নতার ছায়া পড়িল, তিনি বলিলেন, ‘চাঁদনী, খোকাকে এখানে এনেছ কেন? যাও, ওকে নার্সের কাছে রেখে এস।‘
প্রভুভক্ত কুকুর প্রভুর ধমক খাইয়া যেভাবে তাকায়, যুবতীও সেইভাবে শকুন্তলার মুখের পানে চাহিলেন, তারপর নম্রভাবে ঘাড় হেলাইয়া শিশুকে লইয়া যে পথে আসিয়াছিলেন। সেই পথে ফিরিয়া চলিলেন।
দীপনারায়ণ দূর হইতে স্ত্রীকে আহ্বান করিলেন—’শকুন্তলা? কয়েকজন হোমরাচোমরা অতিথি আসিয়াছেন।
শকুন্তলা সেই দিকে গেলেন। পাশের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া দেখিলাম, দেবনারায়ণ কোলা ব্যাঙের মত ড্যাবডেবে চোখ মেলিয়া শকুন্তলার পানে চাহিয়া আছে।
আমরা আবার সিগারেট ধরাইলাম। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘দ্বিতীয় মহিলাটি কে?’
ডাক্তার পালিত অন্যমনস্কভাবে বলিলেন, ‘দেবনারায়ণের স্ত্রী। ছেলেটিও দেবনারায়ণের।’
লক্ষ্য করিলাম ডাক্তার পালিতের কপালে একটু ভ্রূকুটির চিহ্ন। তাঁহার চক্ষুও শকুন্তলাকে অনুসরণ করতেছে।
সাড়ে আটটার সময় আহারের আহ্বান আসিল।
অন্য একটি হল-ঘরে টেবিল পাতিয়া আহারের ব্যবস্থা। রাজকীয় আয়োজন। কলিকাতার কোন বিলাতি হোটেল হইতে পাচক ও পারিবেশক আসিয়াছে। আহার শেষ করিয়া উঠিতে পৌঁনে দশটা বাজিল।
বাহিরের হল-ঘরে আসিয়া পান সিগারেট সেবনে যত্নবান হইলাম। ডাক্তার পালিত একটি পরিতৃপ্ত উদগীর তুলিয়া বলিলেন, ‘মন্দ হল না। —আচ্ছা, আজ চলি, রাত্তিরে বোধহয় একবার রুগী দেখতে বেরুতে হবে। আবার কাল সকালেই দীপনারায়ণবাবুকে ইনজেকশন দিতে আসিব।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখনও ইনজেকশন চলছে নাকি?’
পালিত বলিলেন, ‘হ্যাঁ, এখনও হস্তায় একটা করে লিভার দিচ্ছি। আর গোটা দুই দিয়ে বন্ধ করে দেব। আচ্ছা-নমস্কার। আপনারা তো এখনও আছেন, দেখা হবে নিশ্চয়–
তিনি প্রস্থানের জন্য পা বাড়াইয়াছেন এমন সময় দেখিলাম সদর দরজা দিয়া ইন্সপেক্টর রতিকান্ত চৌধুরী প্রবেশ করিতেছে। তাহার পরিধানে পুলিসের বেশ, কেবল মাথায় টুপি নাই। একটু ব্যস্তসমস্ত ভাব। দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সে একবার ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল, তারপর ডাক্তার পালিতকে দেখিতে পাইয়া দ্রুত আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।
‘ডাক্তার পালিত, একটা খারাপ খবর আছে। আপনার ডিসপেনসারিতে চুরি হয়েছে।’
‘চুরি!’
রতিকান্ত বলিল, ‘হ্যাঁ। আন্দাজ ন’টার সময় আমি থানা থেকে বেরিয়ে এখানে আসছিলাম, পথে নজর পড়ল ডিসপেনসারির দরজা খোলা রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি দরজার তালা ভাঙা। ভেতরে গিয়ে দেখলাম। আপনার টেবিলের দেরাজ খোলা, চোর দেরাজ ভেঙে টাকাকড়ি নিয়ে। আমি একজন কনস্টেবলকে বসিয়ে এসেছি। আপনি যান। দেরাজে কি টাকা ছিল?’
পালিত হতবুদ্ধি ইয়া বললেন, ‘টাকা। রাত্রে বেশি টাকা তো থাকে না, বড় জোর দু’চার টাকা ছিল।
‘তবু আপনি যান। টাকা ছাড়া যদি আর কিছু চুরি গিয়ে থাকে আপনি বুঝতে পারবেন।’
‘আমি এখনি যাচ্ছি।’
‘আর, টাকা ছাড়া যদি অন্য কিছু চুরি গিয়ে থাকে আজ রাত্রেই থানায় এত্তালা পাঠিয়ে দেবেন।‘
শকুন্তলা ও পাণ্ডেজি দূরে দাঁড়াইয়া বাক্যালাপ করিতেছিলেন, আমাদের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। পাণ্ডেজি প্রশ্ন করিলেন, ‘কি হয়েছে?’
ডাক্তার পালিত দাঁড়াইলেন না, তাড়াতাড়ি চলিয়া গেলেন। রতিকান্ত চুরির কথা বলিল। তারপর শকুন্তলার দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আমার বড় দেরি হয়ে গেল-খেতে পাবো তো?’
শকুন্তলা একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘পাবেন। আসুন আমার সঙ্গে।’
গৃহস্বামী পূর্বেই বিশ্রামের জন্য প্রস্থান করিয়াছিলেন, আমরা শকুন্তলার নিকট বিদায় লইয়া গৃহে ফিরিলাম।
৩
পরদিন সকাল আন্দাজ ন’টার সময় একখানা মোটর আসিয়া আমাদের বাসার থামিল। ব্যোমকেশ খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিল, ‘পাণ্ডেজি—এত সকালে।’
পরীক্ষণেই পাণ্ডেজি আমাদের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন। পরিধানে পুলিস ইউনিফর্ম, মুখ গভীর। ব্যোমকেশের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে বলিলেন, ‘দীপনারায়ণ সিং মারা গেছেন।’
আমরা ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলাম, কথাটা ঠিক যেন হৃদয়ঙ্গম হইল না।
‘মারা গেছেন।’
‘এইমাত্র রতিকান্ত টেলিফোন করেছিল। সকালবেলা ডাক্তার পালিত এসেছিলেন। দীপনারায়ণ সিংকে ইনজেকশন দিতে। ইনজেকশন দেবার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। আমি সেখানেই যাচ্ছি। আপনারা যাবেন?’