বহ্নি-পতঙ্গ

ব্যোমকেশ দ্বিরুক্তি না করিয়া আলোয়ানাখানা কাঁধে ফেলিল। আমিও উঠিলাম।

‘চলুন।’

মোটরে যাইতে যাইতে কাল রাত্রির দৃশ্যগুলি মনে পড়িতে লাগিল। দীপনারায়ণ সিংকে একবারই দেখিয়াছি‌, কিন্তু তাঁহাকে ভাল লাগিয়াছিল; শিষ্ট সহাস্য ভদ্রলোক‌, রোগ হইতে সারিয়া উঠিতেছিলেন। হঠাৎ কী হইল?’ আর শকুন্তলা–

শকুন্তলা বিধবা হইয়াছেন.অন্তর হইতে যেন এই নিষ্ঠুর সত্য স্বীকার করিতে পারিতেছি না।

গন্তব্য স্থানে পৌঁছিলাম। ফটকের কাছে গোটা তিনেক মোটর দাঁড়াইয়া আছে। পাণ্ডেজি গাড়ি থামাইয়া অবতরণ করিলেন। দেউড়ি পার হইয়া আমরা বাড়ির সদর দরজায় উপস্থিত হইলাম। বাগানে কেহ নাই‌, চারিদিক যেন থমথম করিতেছে।

সদর দরজার সম্মুখে ইন্সপেক্টর রতিকান্ত গম্ভীর মুখে পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিল। আমাদের দেখিয়া তাহার ভ্রূ ঈষৎ উত্থিত হইল‌, কিন্তু সে কিছু না বলিয়া সকলকে সঙ্গে লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।

হল-ঘরের দ্বারের সম্মুখে পালঙ্কের মত আসনটি পূর্ববৎ রহিয়াছে‌, তাহার উপর দীপনারায়ণ সিং-এর মৃতদেহ। মৃতদেহের পাশে বসিয়া ডাক্তার পালিত এক দৃষ্টি মৃতের মুখের পানে চাহিয়া আছেন। ঘরে আর কেহ নাই‌, কেবল আসবাবগুলি গত রাত্রির মতাই সাজানো রহিয়াছে।

আমরা পা টিপিয়া টিপিয়া পালঙ্কের পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। দীপনারায়ণ সিংকে কাল রাত্রে যেমন দেখিয়ছিলাম‌, আজ মৃত্যুর স্পর্শে তাঁহার আকৃতির কোনও পরিবর্তন হয় নাই। চক্ষু মুদিত‌, মুখের স্নায়ু পেশী শিথিল; যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন।

ডাক্তার পালিত এমন তন্ময় হইয়া মৃতের মুখের পানে চাহিয়া ছিলেন যে আমাদের আগমন বোধহয় জানিতে পারেন নাই। পাণ্ডেজির লঘু করুস্পর্শে তাঁহার চমক ভাঙিল। তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়া একে একে আমাদের মুখের পানে চাহিলেন‌, তারপর বলিলেন‌, ‘পোস্ট-মর্টেম হওয়া দরকার। আর-এই শিশিটা রাখুন।’ তাঁহার হাতের কাছে একটি রবারের স্টপার দেওয়া ক্ষুদ্র বাদামী রঙের শিশি ছিল‌, সেটি পাণ্ডেজিকে দিলেন। পাণ্ডেজি শিশি চোখের সামনে তুলিয়া ধরিয়া দেখিলেন তখনও তাহতে প্ৰায় আধ শিশি তরল পদার্থ রহিয়াছে। তিনি শিশিটি রতিকান্তের হাতে দিয়া শান্তকণ্ঠে ডাক্তারকে বলিলেন‌, ‘আসুন‌, ওদিকে গিয়ে বসা যাক।’

ডাক্তার পালিত তাঁহার হ্যান্ডব্যাগটি পালঙ্কের উপর হইতে তুলিয়া লইলেন। আমরা সকলে অদূরে একটি সোফা-সেটে গিয়া বসিলাম। রতিকান্ত দাঁড়াইয়া রহিল। পাণ্ডেজি জিজ্ঞাসা করিলেন। ‘বাড়ির আর সকলে কোথায়?’

রতিকান্ত বলিল‌, ‘তাদের সব ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। মিস মান্না শকুন্তলা দেবীর কাছে আছেন।’

‘মিস মান্না কে? লেডি ডাক্তার?’

পালিত বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। তিনিও এ বাড়ির বাঁধা ডাক্তার। শকুন্তলার অবস্থা দেখে তাঁকে টেলিফোন করে আনিয়ে নিয়েছি।’

‘বেশ করেছেন। দেবনারায়ণের খবর কি?’

‘দেবনারায়ণটা ইডিয়ট-ছেলেমানুষের মত হাউ হাউ করে কাঁদছে। দেওয়ান গঙ্গাধর বংশী তার কাছে আছে। বেচারী চাঁদনীরই বিপদ‌, নিজে কাঁদছে‌, একবার স্বামীর কাছে ছুটে আসছে‌, একবার শকুন্তলার কাছে ছুটে যাচ্ছে।’ তিনি নিশ্বাস ফেলিলেন।

পাণ্ডেজি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন‌, তারপর বলিলেন‌, ‘ডাক্তার পালিত‌, এবার গোড়া থেকে সব কথা বলুন।’

ডাক্তার তাঁহার ব্যাগটি কোলের উপর হইতে নামাইয়া রাখিয়া বলিলেন‌, ‘বলবার বেশি কিছু নেই। আন্দাজ আটটার সময় আমি এসে দেখলাম দীপনারায়ণবাবু ওই পালঙ্কে বসে অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখে হেসে বললেন—এই শীতে আপনি এত শীগগির আসবেন ভাবিনি‌, চা খান। আমি বললাম— আচ্ছা‌, আগে ইনজেকশনটা দিই। চাঁদনী উপস্থিত ছিলেন‌, শকুন্তলা আজ উপস্থিত ছিলেন না। আমি দীপনারায়ণবাবুর নাড়ি দেখলাম‌, নাড়ি বেশ ভাল। তখন সিরিঞ্জে লিভার এক্সট্র্যাক্ট ভরে তাঁর বাহুতে ইনজেকশন দিলাম। ইনট্রামান্ধুলার ইনজেকশন‌, হাঙ্গামা কিছু নেই‌, কিন্তু দীপনারায়ণবাবু আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লেন। দেখলাম তাঁর চোখের পাতা ভারী হয়ে বুজে আসছে; তিনি কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। আমি তখনই তাঁকে এড্রেনালিন দিলাম‌, তারপর আর্টিফিসিয়াল রেসপিরিশন দিতে লাগলাম। কিন্তু কোনও ফল হল না‌, তিন-চার মিনিটের মধ্যে তাঁর ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল।’

ডাক্তার একবার নিজের বুকের উপর আঙুল বুলাইয়া নীরব রহিলেন। তিনি প্রবীণ ডাক্তার‌, আকস্মিক মৃত্যু তাঁহার কাছে নূতন নয়। কিন্তু তিনি যে ভিতরে ভিতরে কত বড় ধাক্কা খাইয়াছেন তাহা তাঁহার কঠিন সংযম ভেদ করিয়া ফুটিয়া উঠিল।

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘মৃত্যুর কারণ কী তা আপনি বুঝতে পারেননি?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘লক্ষণ দেখে মনে হয়েছিল–এনাফিলেকটিক শক। কিন্তু এখন দেখছি তা নয়।‘

‘তবে কী হতে পারে?’

‘ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়তো কোনও বিষ।’

পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন, ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিউরারি বিষ হতে পারে কি?’

ডাক্তার চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন‌, তারপর কতকটা নিজ মনেই বলিলেন‌, ‘কিউরারি। হতে পারে। তবে পোস্ট-মর্টেম না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চয় বলা যায় না।’

‘যদি কিউরারি বিষে মৃত্যু হয়ে থাকে পোস্ট-মর্টেমে কিউরারি পাওয়া যাবে?’

‘যাবে। কিডনীতে পাওয়া যাবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ডাক্তারবাবু্‌, আপনি যে শিশিটা এখনি পাণ্ডেজিকে দিলেন ওটা কি?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘ওটা লিভার এক্সট্র্যাক্টের ভায়াল। ওতে দশ শিশি ওষুধ থাকে‌, ভায়ালের মুখ রবার দিয়ে সীল করা থাকে। সিরিঞ্জের ছুঁচ রবারে ঢুকিয়ে ভায়াল থেকে দরকার মতো ওষুধ বের করে নেওয়া যায়। আজ আমি ওই ভয়াল থেকেই ওষুধ বের করে ইনজেকশন দিয়েছিলাম।’

0 Shares