ব্যোমকেশ বলিল, ‘ইনজেকশন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন মৃত্যু হয়েছে তখন অনুমান করা যেতে পারে যে ইনজেকশনই মৃত্যুর কারণ। তাহলে ওই ভায়ালে বিষ আছে?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘তাছাড়া আর কি হতে পারে? অথচ-কাল সন্ধ্যেবেলা ওই ভায়াল থেকেই একজন রুগীকে ইনজেকশন দিয়েছি, সে দিব্যি বেঁচে আছে।’
‘ভায়ালটা আপনার ব্যাগের মধ্যেই থাকে?’
‘হ্যাঁ। ফুরিয়ে গেলে একটা নতুন ভায়াল রাখি।’
‘আচ্ছা, বলুন দেখি, কাল রাত্তিরে আপনার ব্যাগ কোথায় ছিল?’
‘ডিসপেনসারিতে ছিল।’
‘রাত্তিরে যখন কল আসে তখন কি করেন, ডিসপেনসারি থেকে ব্যাগ নিয়ে রুগী দেখতে যান?’
‘না, আমার বাড়িতে আর একটা ব্যাগ থাকে, রাত্তিরে কল এলে সেটা নিয়ে বেরুই।’
‘বুঝেছি। কাল রাত্তিরে যখন আপনার ডিসপেনসারিতে চোর ঢুকেছিল তখন এ ব্যাগটা সেখানেই ছিল?’
‘হ্যাঁ।’ ডাক্তার চকিত হইয়া উঠিলেন—’কাল রাত্ৰি আন্দাজ সাতটার সময় আমি রুগী দেখে ডিসপেনসারিতে ফিরে আসি। তখন আর বাড়ি ফেরবার সময় ছিল না, ব্যাগ রেখে কম্পাউণ্ডারকে বন্ধ করতে বলে সটান এখানে চলে এসেছিলাম।’
‘ও’—ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিল, ‘কম্পাউণ্ডার কখন ডিসপেনসারি বন্ধ করে চলে গিয়েছিল আপনি জানেন?’
‘জানি বৈকি। কাল রাত্রে চুরির খবর পেয়ে এখান থেকে ফিরে গিয়ে আমি কম্পাউণ্ডারকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, সাতটার পরই সে ডাক্তারখানা বন্ধ করে নিজের বাড়ি চলে গিয়েছিল।’
‘ভাল কথা, ডিসপেনসারি থেকে আর কিছু চুরি গিয়েছিল। কিনা জানতে পেরেছেন?’
‘আর কিছু চুরি যায়নি। শুধু টেবিলের দেরাজ থেকে কয়েকটা টাকা আর সিকি আধুলি গিয়েছিল।’
ব্যোমকেশ পাণ্ডেজির দিক হইতে রতিকান্তের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া শান্ত কণ্ঠে বলিল, ‘তাহলে চুরির আসল উদ্দেশ্য বোঝা গেল।’
রতিকান্ত এতক্ষণ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া ব্যোমকেশের সওয়াল জবাব শুনিতেছিল। যে প্রশ্ন পুলিসের করা উচিত তাহা একজন বাহিরের লোক করিতেছে ইহা বোধহয় তাহার ভাল লাগে নাই। কিন্তু ব্যোমকেশ পাণ্ডেজির বন্ধু, তাই সে নীরব ছিল। এখন সে একটু নীরস স্বরে বলিল, ‘কী বোঝা গেল?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝতে পারলেন না? চোর টাকা চুরি করতে আসেনি। সে লিভার এক্সট্র্যাক্টের ভায়ালটা বদলে দিয়ে গেছে।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘বদলে দিয়ে গেছে?’
‘কিম্বা ডাক্তারবাবুর ভায়ালে কয়েক ফোঁটা তরল কিউরারি সিরিঞ্জের সাহায্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। ফল একই। চোর জানত আজ সকালবেলা দীপনারায়ণ সিংকে ইনজেকশন দেওয়া হবে।–এবার ব্যাপারটা বুঝেছেন?’
কিছুক্ষণ সকলে স্তব্ধ হইয়া রহিলাম। তারপর পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আজ সকালে ইনজেকশন দেওয়া হবে কে কে জানত?’
ডাক্তার বলিলেন, ‘বাড়ির সকলেই জানত রবিবার সকালে ইনজেকশন দেওয়া হয়, আমি প্রথমে ওঁকে ইনজেকশন দিয়ে তারপর রুগী দেখতে বেরুই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কাল রাত্তিরে আমিও জানতে পেরেছিলাম, ডাক্তারবাবু বলেছিলেন। সুতরাং ওদিক থেকে কাউকে ধরা যাবে না।’
ইন্সপেক্টর রীতিকান্ত কথা বলিল, পিছন হইতে পাণ্ডেজির চেয়ারের উপর কুকিয়া বলিল, ‘স্যার, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো অপঘাত মৃত্যু, ডাক্তার পালিত ভুল করে অন্য ওষুধ ইনজেকশন দিয়েছেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে–। আমি এ কেসের চার্জ নিতে চাই।’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘নিশ্চয়, তোমারই তো এলাকা। তুমি চার্জ নাও। এখনি লাশ পোস্ট-মর্টেমের জন্য পাঠাও। আর ওই ওষুধের ভায়ালটা পরীক্ষার জন্যে ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দাও। এ ব্যাপারের নিম্পত্তি হওয়া চাই।’
রতিকাস্তের মুখ কঠিন হইয়া উঠিল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার, নিস্পত্তি আমি করব? দীপনারায়ণবাবু আমার মুরুব্বি ছিলেন, কুটুম্ব ছিলেন, তাঁকে যে খুন করেছে। সে আমার হাতে ছাড়া পাবে না।‘
তাহার কথাগুলা একটু নাটুকে ধরনের হইলেও ভিতরে খাঁটি হৃদয়াবেগ ছিল। সে স্যালুট করিয়া চলিয়া যাইতেছিল, পাণ্ডেজি বলিলেন, রতিকান্ত, আমার বন্ধু ব্যোমকেশ বক্সীকে তুমি বোধহয় চেনো না। উনি বিখ্যাত ব্যক্তি, আমাদের লাইনের লোক। উনিও তোমাকে সাহায্য করবেন।’
রতিকান্ত ব্যোমকেশের পানে চাহিল। ব্যোমকেশ সম্বন্ধে তাহার মনে খানিকটা বিস্ময়ের ভাব ছিল, এখন সত্য পরিচয় পাইয়া সে সুখী হইতে পারে নাই তাহা স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল। সে ধীরে ধীরে বলিল, ‘আপনি বিখ্যাত ব্যোমকেশ বক্সী? আপনার কয়েকটি কাহিনী আমি পড়েছি, হিন্দীতে অনুবাদ হয়েছে। তা আপনি যদি অনুসন্ধানের ভার নেন–’
ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি বলিল, ‘না না, তদন্ত আপনি করবেন। আমার পরামর্শ যদি দরকার হয় আমি সাধ্যমত সাহায্য করব—এর বেশি কিছু নয়।’
রতিকান্ত বলিল, ‘ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য পাওয়া তো ভাগ্যের কথা।–আচ্ছা স্যার, আমি এবার যাই, লাশের ব্যবস্থা করতে হবে।’ স্যালুট করিয়া রতিকান্ত চলিয়া গেল।
আমরাও উঠিলাম। এখানে বসিয়া থাকিয়া আর লাভ নাই। ডাক্তার পালিত ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ‘আমি শকুন্তলাকে একবার দেখে যাই। অবশ্য, তার কাছে মিস মান্না আছেন—‘
এই সময় বাড়ির ভিতর দিক হইতে একটি মহিলা প্রবেশ করিলেন। দীর্ঘাঙ্গী, আঁট-সাঁট শাড়ি পরা, চোখে চশমা, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, ভাবভঙ্গীতে চরিত্রের দৃঢ়তা পরিস্ফুট। তাঁহাকে দেখিয়া ডাক্তার পালিত সেই দিকে অগ্রসর হইয়া গেলেন। দুইজনে নিম্ন স্বরে কথা হইতে লাগিল।
ব্যোমকেশ পাণ্ডেজির পানে চাহিয়া ভ্রূ তুলিল, পাণ্ডেজি হ্রস্বকণ্ঠে বলিলেন, ‘মিস মান্না।’