বহ্নি-পতঙ্গ

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘ঘোড়া জগন্নাথের সঙ্গে আপনার বর্ণনা খাসা মিলে যাচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঘোড়া জগন্নাথের মোটিভ খুব জোরালো নয়। অবশ্য তার যদি অন্য কোনও মোটিভ থাকে তাহলে আলাদা কথা। আচ্ছা‌, একটা কথা জিগ্যেস করি কিছু মনে করবেন না। শকুন্তলা দেবী সুন্দরী এবং আধুনিকা‌, পাটনা শহরে তাঁর অনুরাগী এডমায়ারার নিশ্চয় আছে?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘তা আছে। শুনেছি রোজ সন্ধ্যেবেলা দু’চারজন পয়সাওয়ালা আধুনিক ছোকরা দীপনারায়ণের বাড়িতে আড্ডা জমাতো। ব্রিজ খেলা‌, চা-কেক খাওয়া‌, হাসি গল্প গান–এই সব চলত। ঘোড়া জগন্নাথ বড়মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসে‌, সেও ওদের দলে থাকত। তবে মাস ছয়েক আগে দীপনারায়ণ যখন অসুখে পড়লেন তখন ওদের আড্ডা ভেঙে গেল। দু’এক জন মাঝে মাঝে খোঁজ-খবর নিতে যেত। নর্মদাশঙ্কর—‘

‘নর্মদাশঙ্কর কে?’

‘বড়মানুষের অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে। এলাহাবাদের লোক। বিহারে জমিদারী আছে। শুধু অকালকুম্মাণ্ড নয়–পাজি। পুলিসের খাতায় নাম আছে। একবার শিকার করতে গিয়ে একটা দেহাতি মেয়েকে নিয়ে লোপাট হয়েছিল। ব্যাপার খুব ঘোরালো হয়ে উঠেছিল‌, তারপর মেয়ের বাপকে টাকাকড়ি দিয়ে মোকদ্দমা ফাঁসিয়ে দিলে–’

‘নর্মদাশঙ্কর দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে যাতায়াত করত?’

‘হ্যাঁ‌, নর্মদাশঙ্কর বাইরে খুব চোস্ত কেতা-দুরস্ত লোক‌, চেহারা ভাল‌, মিষ্টি কথা। কিন্তু আসলে পাজির পাঝাড়া।’–পাণ্ডেজি মুখের অরুচি-সূচক একটা ভঙ্গী করিলেন—’স্ত্রী-স্বাধীনতা খুবই বাঞ্ছনীয় বস্তু‌, অসুবিধা এই যে ভদ্রবেশী লুচ্চাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না।’

‘হুঁ। শকুন্তলা দেবী কি এদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা করতেন?’

‘তা করতেন। কিন্তু তাঁর সত্যিকার বদনাম কখনও শুনিনি। যারা অতি উচুতে নাগাল পেত না তারা নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্কার করত‌, টিটকিরি দিত—এই পর্যন্ত।’

‘ওটা আমাদের স্বভাব—দ্রাক্ষাফল অতি বিস্বাদ ও অমরসে পরিপূর্ণ।’ ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল–’এখন তাহলে ওঠা যাক। আপনি কি আর ওদিকে যাবেন?’

‘বিকেলবেলা যাব। আপনারাও যদি আসেন–’

‘নিশ্চয় যাব। বাড়ির লোকগুলিকে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখা দরকার।’

বৈকাল চারটি বাজিবার পূর্বেই পাণ্ডেজি গাড়ি লইয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন‌, চলুন‌, একবার থানা হয়ে যাব। হয়তো পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এসেছে।’

তিনজনে থানায় উপস্থিত হইলাম। শহরের মাঝখানে থানা। রতিকান্ত উপস্থিত ছিল‌, আমাদের সসন্ত্রমে লইয়া গিয়া নিজের অফিস ঘরে বসাইল। বলিল‌, ‘এইমাত্র পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট পেলাম‌, কিউরারি পাওয়া গেছে। মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই।’

পাণ্ডেজি রিপোর্টের উপর একবার চোখ বুলাইয়া বলিলেন‌, ‘আর ওষুধ পরীক্ষার রিপোর্ট?’

‘সেটা এখনও আসেনি। আমি জরুরী তাগাদা দিয়ে এসেছি। বোধহয় আজ রাত্রেই পাওয়া যাবে। ওষুধের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত ভালভাবে তদন্ত আরম্ভ করা যাচ্ছে না। তবে লোক লাগিয়েছি, কিউরারি নিয়ে কেউ চোরাকারবার করে কিনা খবর নিতে।‘

পাণ্ডেজি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘ঠিক করেছ। যে চোরটার কাছে কিউরারির শিশি পাওয়া গিয়েছিল। সে তো এখন জেলেই আছে। তাকে দম দিলে হয়তো খবর পাওয়া যেতে পারে কারা কিউরারির চোরাকারবার করে।‘

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। খবর নিয়েছি সে কয়েদীটো এখন পাটনা জেলে নেই‌, বক্সার জেলে আছে। তার সঙ্গে মুলাকাতের ব্যবস্থা করছি। ইতিধ্যে ডাক্তার পালিতের কম্পাউণ্ডারকে জেরা করেছি।’

‘কিছু পেলে?’

‘কিছু না।–ওদিকে দীপনারায়ণজির বাড়ির সকলকে বাড়িতেই থাকতে বলেছি। বাইরের লোকের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি‌, কেবল ম্যানেজার গঙ্গাধর আর তার ছেলে লীলাধর ছাড়া।’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘আমরা এখন সেখানেই যাচ্ছি। তুমি আসবে নাকি?’

রতিকান্ত একটু ইতস্তত করিয়া বলিল‌, ‘আপনারা এগোন‌, আমি একটা জরুরী কাজ সেরে যাচ্ছি।’ তারপর হাসিয়া ব্যোমকেশকে বলিল,–’আপনি কিছু ঠাহর করতে পারলেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উহু। কিন্তু মনে হচ্ছে বাড়ির কাউকেই সন্দেহ থেকে বাদ দেওয়া যায় না।‘

রতিকান্ত বলিল‌, ‘শুধু বাড়ির লোক নয় স্টেটের কর্মচারীদেরও বাদ দেওয়া যায় না। সকলকেই অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় ফেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।’

ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে বলিল‌, ‘ডাক্তার পালিতকে আপনার কেমন মনে হয়?’

রতিকান্ত চকিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিল‌, ‘ডাক্তার পালিত! কিন্তু তিনি-যদি তাঁর কোনও মোটিভ থাকত‌, তিনি নিজের হাতে একাজ করতেন কি?’

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিল‌, ‘তিনি নিজের হাতে একাজ করেছেন বলেই তাঁর ওপর সন্দেহ কম হবে।—’

মোটরে ফিরিয়া গিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘ডাক্তার পালিতের ডিস্‌পেনসারি কি কাছেই?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘এই তো খানিক দূর‌, রাস্তাতেই পড়বে। যাবেন নাকি সেখানে?’

‘চলুন‌, আসল অকুস্থলটা দেখে যাওয়া যাক।’

দুতিন মিনিটের মধ্যে ডাক্তার পালিতের ডাক্তারখানায় পৌঁছিলাম। এটিও বড় রাস্তার উপর‌, চারিদিকে দোকানপাট‌, বসতবাড়ি নেই। শীতের রাত্রে আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায়‌, তখন চোরের তালা ভাঙিয়া ভিতরে প্রবেশ করিবার কোনই অসুবিধা নাই।

ডাক্তারখানাটি নিতান্তাই মামুলী। সামনে পিছনে দু’টি ঘর‌, সামনের ঘরে রুগী আসিয়া বসে‌, ভিতরের ঘরে ডাক্তার বসেন। কম্পাউণ্ডার ভিতরের ঘরেই ঔষধ তৈয়ার করে।

0 Shares