‘আপনারা চলে আসবার পর থিয়েটারের মঞ্চ স্ত্রীনিরুম অডিটোরিয়াম, তারপর হাতার মধ্যে প্রভুনারায়ণের কোয়ার্টার-সব খানাতল্লাশ করলাম; স্টেজের দোরের কাছে দুটো মোটর ছিল—একটা বিশু পালের, দ্বিতীয়টা মণীশ ভদ্র’র-সে দুটোও খুঁজে দেখলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। আর্টিস্টরা সবাই ব্যাগ হাতে করে অভিনয় করতে আসে, তাদের ব্যাগের মধ্যেও সাধারণ কাপড়-চোপড় পাউডার লিপস্টিক ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। কেবল মালবিকার ব্যাগে একটা নিরুনের মত ধারালো ছুরি। আর ব্রজদুলালের ব্যাগে এক বোতল হুইস্কি পাওয়া গেল। তারপর নিষ্ফল বডি সার্চ।’
মাধব মিত্র চায়ের পেয়ালা শেষ করে রুমালে মুখ মুছলেন, বললেন, ‘অতঃপর সাক্ষীদের জবানবন্দী নিতে শুরু করলাম। প্রথমে বিশু পালের ভাই অমল পাল–’
ব্যোমকেশ হাত তুলে বলল, ‘জবানবন্দী মুখে বলতে গেলে অনেক কথা বাদ পড়ে যাবে। তার চেয়ে যদি জবানবন্দীর নথি আপনার কাছে থাকে—‘
মাধববাবু ফাইলের ওপর হাত রেখে একটু দ্বিধাভরে বললেন, ‘আছে। একটা কপি সর্বদাই সঙ্গে থাকে। কিন্তু–মুশকিল কি জানেন, ফাইল হাতছাড়া করার নিয়ম নেই। যাহোক, এক কাজ করা যেতে পারে, আমি বসছি, আপনি ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিন। আপনার পড়াও হবে, নিয়ম রক্ষেও হবে। কি বলেন?’
ব্যোমকেশ নিম্পূহ স্বরে বলল, ‘দেখুন, আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনার যদি আগ্রহ থাকে। তবেই জবানবন্দী পড়ব।’
মাধববাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না না, সে কি কথা! আমার আগ্রহ আছে বলেই না আপনার কাছে এসেছি।’ তিনি ফাইল থেকে টাইপ করা ফুলস্ক্যাপ কাগজের একটা নথি বার করে ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘এই নিন। আপনি পড়ুন, আমি না হয় ততক্ষণ প্রতুলবাবুর সঙ্গে পাশের ঘরে বসে গল্প করি।’
ব্যোমকেশ নথি টেনে নিয়ে বলল, ‘মন্দ কথা নয়। প্রতুলবাবু আপনাকে কিছু নতুন খবর দিতে পারবেন। আমিও একটা খবর দেব। আগে জবানবন্দী পড়ি। ডাক্তারের ময়না তদন্তের রিপোর্ট নথিতে আছে নাকি?’
‘আছে। তিনি ডাক্তারি পরিভাষার কচুকচি রিপোর্টে যথাসম্ভব সরল করে দিয়েছেন।’
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরিয়ে জবানবন্দীর নথির পাতা খুলে পড়তে আরম্ভ করল।
থিয়েটারের অফিস ঘরে বসে মাধব মিত্র একের পর এক সাক্ষী ডেকে তাদের এজাহার নিয়েছিলেন। একজনের এজাহার নেবার সময় অন্য কোনো সাক্ষী উপস্থিত ছিল না।
অমল পাল। বয়স-৩৯। জীবিকা-ডাক্তারি। ঠিকানা–** গোলাম মহম্মদ রোড, দক্ষিণ কলিকাতা।
মৃত বিশ্বনাথ পাল আমার দাদা ছিলেন। আমরা দুই ভাই; আমি কনিষ্ঠ। দাদা আমার পড়ার খরচ দিয়ে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন। আমি দক্ষিণ কলকাতায় প্র্যাকটিস করি, দাদা থিয়েটারের কাছে থাকার জন্যে শ্যামবাজারে থাকতেন। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান ছিলেন। শ্যামবাজারের বাসায় অভিনেত্রী সুলোচনা তাঁর সঙ্গে থাকত। আমার সুযোগ হলে আমি থিয়েটারে এসে কিম্বা শ্যামবাজারের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। তাঁর সঙ্গে আমার পরিপূর্ণ সদ্ভাব ছিল, তিলমাত্র মনোমালিন্য কোনো দিন হয়নি।
দাদা উদার চরিত্রের মানুষ ছিলেন, পরোপকারী ছিলেন। তিনি পনেরো হাজার টাকার লাইফ ইনসিওর করে আমাকে তার ওয়ারিশ করেছিলেন। শুনেছি থিয়েটারের আরো অনেক লোককে লাইফ ইনসিওরের ওয়ারিশ করেছিলেন। কাউকে দশ হাজার, কাউকে পাঁচ হাজার। তিনি অজস্র টাকা রোজগার করতেন, কোনো বদখেয়াল ছিল না; যাদের ভালবাসতেন তাদের দু’হাত ভরে দিতেন।
নৈতিক চরিত্র? তিনি আমার গুরুজন ছিলেন, তাঁর নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই। সুলোচনার সঙ্গে ওঁর বিবাহিত সম্বন্ধ না থাকলেও ওঁরা স্বামী-স্ত্রীর মতই থাকতেন।
দাদার শত্ৰু? শত্ৰু কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। সকলেই তাঁর অনুগৃহীত, শত্ৰুতা কে করবে?
আমি আজ এ পাড়ায় একটা ‘কল’এ এসেছিলাম, ভাবলাম দাদার সঙ্গে দুটো কথা বলে যাই; তাই থিয়েটারে এসেছিলাম। আমার ডাক্তারি প্র্যাকটিস মোটের ওপর মন্দ নয়। আমি বিবাহিত; তিনটি মেয়ে দু’টি ছেলে।
আজ নাটক শেষ হবার ঠিক আগে যখন এক মিনিটের জন্যে আলো নিভিয়ে দেওয়া হল তখন আমি স্টেজের পিছন দিকে একটা টুলের ওপর বসে সিগারেট টানছিলাম। তখন কে কোথায় ছিল, নিজের জায়গা থেকে নড়েছিল। কিনা। আমি লক্ষ্য করিনি। আলো জ্বলার পরে আবার অভিনয় আরম্ভ হল, কিছুক্ষণ পরে চীৎকার কান্না হৈ হৈ্্, ড্রপিসিন পড়ে গেল। তখন আমি স্টেজে এসে দেখলাম–
আমি ডাক্তার, কিন্তু দাদার মৃত্যুর কারণ আমি বুঝতে পারিনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যু-হার্ট ফেলিওর হতে পারে। কিন্তু দাদার হার্ট দুর্বল ছিল না, কয়েক দিন আগে আমি পরীক্ষা করেছি। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পোস্ট-মর্টেমে জানা যাবে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্বপাত, এখনো ঠিক ধারণা করতে পারছি না।
দাদা যদি উইল করে গিয়ে থাকেন তাহলে কে তাঁর উত্তরাধিকারী আমি জানি না, সলিসিটার সিংহ-রায়ের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যাবে। যদি উইল না থাকে তাহলে সম্ভবত আমিই তাঁর উত্তরাধিকারী। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি কী আছে আমি জানি না।
ব্রজদুলাল ঘোষ। বয়স-৪২। জীবিকা-নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—** শ্যামপুকুর লেন। ইন্সপেক্টরবাবু্, আপনি সুলোচনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে এখনো সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ হয়নি। আপনি আগে আমাকে প্রশ্ন করুন। আমার এজাহার শেষ হলে সুলোচনা আসবে।
প্রশ্ন : আপনি এই নাটকে ভীমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন?