উত্তর : হ্যাঁ। বিশু যতগুলি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল সব নাটকেই আমি অভিনয় করেছি।
প্রশ্ন : কতদিন তাঁর সঙ্গে আছেন?
উত্তর : তা প্ৰায় দশ বছর। বিশু যখন নিজের দল তৈরি করে আসরে নামল তখন থেকে আমি ওর সঙ্গে আছি।
প্রশ্ন : আপনার মত আর কেউ গোড়া থেকে আছে?
উত্তর : গোড়া থেকে–। আছে। কমিক অভিনেতা দাশরথি চক্কোত্তি আর তার বৌ নন্দিতা। অন্য যারা ছিল তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন : আপনাদের কারুর সঙ্গে বিশু পালের অসদ্ভাব ছিল?
উত্তর : দেখুন, কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করা যায় না। কার মনে কি আছে জানি না, কিন্তু বাইরে কোনো অসদ্ভাব ছিল না। বিশু ছিল দিলাদরিয়া মেজাজের লোক, দলের লোককে সে ঘরের লোক বলে মনে করত। এমন অমায়িক চরিত্র দেখা যায় না।।
প্রশ্ন : বিশু পালের চরিত্রে কোনো দোষ ছিল না?
উত্তর : একটু আধটু দোষ কার না থাকে? ঠিক বাছতে গাঁ উজোড়। বিশু মরে গেছে, কিন্তু আমি গলা ছেড়ে বলতে পারি সে উঁচু মেজাজের সজ্জন ব্যক্তি ছিল। যারা তার দলে কাজ করেছে তারা সপরিবারে কাজ করেছে। সমস্ত থিয়েটারটাই একটা পারিবারিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন আমাদের সকলের এজমালি থিয়েটার। এখন সে মরে গেছে, এরপর কী হবে জানি না।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এবার আপনার ঘরের কথা কিছু জিজ্ঞেস করি। আপনার পরিবারে কে কে আছে?
উত্তর : বুড়ি পিসি আছেন। আমার স্ত্রী শান্তি আছে আর একটি মেয়ে আছে। মেয়ে স্কুলে পড়ে। শান্তি আমাদের থিয়েটারে গান-বাজনা শেখায়।
প্রশ্ন : তিনি আজ আসেননি?
উত্তর; না। নতুন নাটকের যখন মহড়া আরম্ভ হয় তখন সে আসে, নাচ-গান শেখায়; নাটক একবার চালু হলে তার কাজ থাকে না, তখন আর বড় একটা আসে না। বাড়িতে একটা নাচ-গানের কোচিং ক্লাস খুলেছে, তাইতে শেখায়।
প্রশ্ন : আপনি থিয়েটারে যোগ দেবার আগে কোনো কাজ করতেন কি?
উত্তর : হ্যাঁ, আমি মুষ্টিযোদ্ধা ছিলাম। একবার ভারতের মিড়ল-ওয়েট চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম। একটি জিমনেসিয়ামে বক্সিং শেখাতাম। কিন্তু থিয়েটারের শখ বরাবরই ছিল, একটা সুযোগ পেয়ে চলে এলাম।
প্রশ্ন : আজ স্টেজের ওপর বিশু পালের সঙ্গে আপনার মল্লযুদ্ধ হয়েছিল; তখন আপনি বিশু পালের শরীরে কোনো দুর্বলতা লক্ষ্য করেছিলেন?
উত্তর : না। ঠিক অন্য দিনের মত।
প্রশ্ন : কখন জানতে পারলেন বিশু পালের মৃত্যু হয়েছে?
উত্তর; আমি জানতে পারিনি। লাইট অফু হয়ে যাবার পর আমি আর সুলোচনা পিছন দিকের দোরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আলো জ্বললে স্টেজে এসে অ্যাকটিং আরম্ভ করলাম। এই সময় বিশুর মাটি থেকে উঠে আমার পিঠে ছুরি মারবার কথা; কিন্তু বিশু উঠল না। তারপরই সুলোচনা চীৎকার করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন আমি বুঝতে পারলাম।
প্রশ্ন : এর বেশি আপনি কিছু জানেন না? আচ্ছা, আজ আপনি বাড়ি যান। যদি নতুন কিছু মনে পড়ে জানাবেন।
সুলোচনা। বয়স-৩৫। জীবিকা-নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—** শ্যামবাজার, উত্তর কলিকাতা।
সুলোচনা মুখের রঙ অনেকটা পরিষ্কার করেছে, তবু কানে ও গলায় কিছু পেন্ট লেগে আছে। তার গায়ের রঙ ফরসা, শরীরের গড়ন ভাল; কিন্তু আকস্মিক বিপর্যয়ে একেবারে যেন ভেঙে পড়েছে। অফিস ঘরে এসে মাধব মিত্রের সামনের চেয়ারে সে বসে পড়ল, আর্তম্বরে নিজেই প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘কে একাজ করল, দারোগাবাবু?’
উত্তরে দারোগা প্রশ্ন করলেন, ‘কোন কাজ? সুলোচনার চোখ দারোগার মুখের ওপর স্থির হল, গলার স্বরে তীক্ষ্ণতা এল। সে বলল, ‘আপনি জানেন না কোন কাজ? ওঁর শরীরে কোনো রোগ ছিল না, ওঁর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। কেউ ওঁকে খুন করেছে।’
প্রশ্ন : এ বিষয়ে এখনো ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি, তবে আপনার অনুমান সত্যিও হতে পারে। যদি সত্যি হয়, কে খুন করেছে আপনি বলতে পারেন?
উত্তর : তা কি করে বলব। কিন্তু ওঁর কোনো শত্রু ছিল না।
প্রশ্ন; শত্ৰু না থাকলেও বিশু পালের মৃত্যুতে অনেকের লাভ ছিল। যাদের উদ্দেশ্যে উনি লাইফ ইনসিওর করেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে তাদের সকলেরই লাভ। নয় কি?
উত্তর : তা সত্যি কিন্তু এমন কে আছে কয়েকটা টাকার জন্যে চিরজীবনের উপকারী বন্ধুকে খুন করবে!
প্রশ্ন : আপনি কাউকে সন্দেহ করেন না?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : বাইরের কেউ হতে পারে না?
উত্তর : বাইরের লোক! তা জানি না। তিনি থিয়েটারের বাইরের অনেক লোককে চিনতেন, কার মনে কী আছে কেমন করে জানিব?
প্রশ্ন : আচ্ছা যাক। আপনার সঙ্গে বিশুবাবুর কতদিনের পরিচয়?
উত্তর : প্ৰায় পাঁচ বছর।
প্রশ্ন : কোথায় পরিচয় হয়েছিল? কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? উত্তর; এই থিয়েটারে পরিচয় হয়েছিল। ব্রজদুলালবাবু আগে থাকতে আমাকে চিনতেন, তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : আগেও থিয়েটার করতেন নাকি? উত্তর : নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে করতাম।
প্রশ্ন : আপনার পারিবারিক পরিস্থিতি কিছু জানতে চাই। উত্তর; মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কম বয়সে বিধবা হয়েছিলুম। থিয়েটারের দিকে ঝোঁক ছিল। সুযোগ পেয়ে চলে এলুম।
প্রশ্ন : এ থিয়েটারে আসার পর থেকে বিশুবাবুর সঙ্গে আছেন?
উত্তর; হ্যাঁ। বিয়ে হয়নি, কিন্তু উনিই আমার স্বামী।
প্রশ্ন : বাপের বাড়ির সঙ্গে আর আপনার কোনো সম্বন্ধ নেই?
উত্তর : না। আমার মা বাবা নেই, দাদা খবর রাখেন না।
প্রশ্ন : ডাক্তার অমল পালের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
উত্তর : ভাল। সে তার দাদাকে শ্রদ্ধা করত। বাড়িতে বড় একটা আসত না, দরকার হলে এখানে এসে দাদার সঙ্গে দেখা করত।
প্রশ্ন : কিসের দরকার-টাকার?