বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত)

উত্তর : হ্যাঁ। বেশির ভাগই টাকা। ওর ডাক্তারি ভাল চলে না। অনেকগুলি ছেলেমেয়ে–

প্রশ্ন : বিশু পালের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এখন কে পাবে আপনি জানেন?

উত্তর : যতদূর জানি উনি উইল করে যাননি। স্থারর সম্পত্তির কথাও কখনো শুনিনি। ব্যাঙ্কে কিছু টাকা আছে‌, আর মোটর গাড়িটা আছে। ব্যাঙ্কের টাকা কে পাবে তা জানি না‌, তবে গাড়িটা আমার নামে আছে‌, সম্ভবত আমার নামেই থাকবে।

প্রশ্ন : এবার শেষ প্রশ্ন। আজ অভিনয়ের সময় কিছু দেখেছেন কিম্বা শুনেছেন কি যা আমাদের কাজে লাগতে পারে?

সুলোচনা একটু চিন্তা করে বলল, ‘সন্দেহজনক কিছু নয়, তবে সোমরিয়াকে উইংসের বাইরে এক কোণে লুকিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। সে মাঝে মাঝে ভিতরে এসে থিয়েটার দেখে।’

প্রশ্ন : সোমরিয়া কে?

উত্তর : দারোয়ান প্রভু সিং-এর বোন।

ইন্সপেক্টর : আচ্ছা‌, আজ এই পর্যন্ত।

মণীশ ভদ্র। বয়স-২৯। জীবিকা-থিয়েটারের আলোকযন্ত্র পরিচালনা। ঠিকানা’’ আমহার্স্ট স্ট্রট।

মণীশ ঘরে ঢুকে একবার কজির ঘড়ির দিকে তাকালো। রেডিয়াম লাগানো ঘড়ি‌, অন্ধকারেও সময় দেখা যায়। সে চেয়ারে বসে বলল‌, ‘পৌঁনে এগারটা। দারোগাবাবু্‌, বড় রাত হয়ে গেছে‌, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন? হোটেল সব বন্ধ হয়ে গেছে‌, আজ আর বোধহয় কিছু জুটবে না—‘

মাধববাবু বললেন‌, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার এজাহার পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না।’

মণীশ বলল‌, ‘আমি একলা নয়‌, বৌও আছে। —দু’জনের এজাহার একসঙ্গে নিলে হয় না?’

মাধববাবু বললেন‌, ‘না‌, তা হয় না। আপনারা দু’জন দু’ জায়গায় ছিলেন। —আচ্ছা‌, বলুন দেখি‌, আলো নেভাবার পর আপনি কী করলেন?’

উত্তর : সুইচের ওপর হাত রেখে ঘড়ির পানে তাকিয়ে রইলাম‌, পীয়তাল্লিশ সেকেন্ড। পরে সুইচ টিপে আলো জ্বাললাম।

প্রশ্ন : আপনার বোর্ডে অনেকগুলি সুইচ‌, কোনটা কোথাকার সুইচ সব আপনার নখদর্পণে?

উত্তর : হ্যাঁ‌, তবু সাবধান থাকা ভাল‌, তাই এই দৃশ্যে সুইচে হাত রাখি।

প্রশ্ন : ঠিক পয়তাল্লিশ সেকেন্ড কেন?

উত্তর : বিশুবাবু সময় ধার্য করে দিয়েছিলেন‌, পয়তাল্লিশ সেকেন্ড হাউস অন্ধকার থাকবে।

প্রশ্ন : আপনার একজন সহকারী আছে না?

উত্তর : আছে। কাঞ্চন সিংহ। সে আমার সঙ্গে সুইচ বোর্ডে ছিল না। তার মাথা ধরেছিল—

প্রশ্ন : তার প্রায়ই মাথা ধরে?

মণীশ চুপ করে রইল।

প্রশ্ন : সে কোথায় ছিল আপনি জানেন?

উত্তর : পরে শুনেছি সে অফিস ঘরে ঘুমোচ্ছিল।

প্রশ্ন; কার মুখে শুনলেন?

উত্তর : তার নিজের মুখে।

প্রশ্ন : ও। বিশুবাবুর সঙ্গে আপনি কতদিন কাজ করছেন?

উত্তর : প্ৰায় চার বছর।

প্রশ্ন : আপনার স্ত্রীও?

উত্তর : না‌, তখন আমার বিয়ে হয়নি। মালবিক থিয়েটারে যোগ দিয়েছে। বছরখানেক‌, এই নাটক ধরবার পর থেকে। বিশুবাবু উত্তরার পার্ট করার জন্যে কমবয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন; শেষ পর্যন্ত মালবিকাকে রাখেন।

প্রশ্ন : আপনার নামে বিশুবাবু জীবনবীমা করেননি?

উত্তর : না। আমি বলেছিলাম জীবনবীমা চাই না‌, মাইনে বাড়িয়ে দিন। তা তিনি জীবনবীমাও করলেন না‌, মাইনেও বাড়ালেন না। সাতশো টাকা ছিল‌, সাতশো টাকাই রইল।

প্রশ্ন : তার বদলে বিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি কিনে দিলেন?

উত্তর : গাড়ির একটা ইতিহাস আছে। বিশুবাবু যখন মাইনে বাড়িয়ে দিলেন না তখন আমি বাইরে কাজ খুঁজতে লাগলাম। এই নাটক আরম্ভ হবার কয়েকদিন আগে আমি মাদ্রাজ থেকে একটা ভাল অফার পেলাম। একটা বিখ্যাত সিনেমা কোম্পানি আলোকশিল্পী চায়; মাইনে দেড় হাজার‌, তাছাড়া বাড়িভাড়া ইত্যাদি। বিশুবাবুকে গিয়ে চিঠি দেখলাম। তিনি বে-কায়দায় পড়ে গেলেন‌, কিন্তু তবু নিজের জিদ ছাড়লেন না। আমাকে গাড়ি কিনে দিলেন। আর মালবিকাকে যে একশো টাকা হাতখরচ হিসেবে দিতেন তা বাড়িয়ে দু’শো টাকা করে দিলেন। তখন আমি মাদ্রাজের অফারটা ছেড়ে দিলাম। দেশ ছেড়ে কে বিদেশে যেতে চায়?

দারোগাবাবু বললেন‌, ‘তা বটে। তাহলে আপনি বিশু পালের মৃত্যু সম্বন্ধে কোনো হদিস দিতে পারেন না? আচ্ছা‌, এবার তাহলে আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন।’

মালবিকা ভদ্র। বয়স-২০। জীবিকা-নাট্যাভিনয়। ঠিকানা ** আমহার্স্ট স্ট্রট।

নোট : বিশু পালের আকস্মিক মৃত্যুতে সাক্ষী প্রথমটা খুব শক খেয়েছিল‌, এখন সুস্থ হয়েছে। বয়স কম‌, দেখতেও সুন্দরী; কিন্তু চোখের ঋজু দৃষ্টি ও চিবুকের মজবুত গড়ন থেকে চরিত্রের দৃঢ়তা অনুমান করা যায়।

প্রশ্ন : নাটকে আপনি উত্তরার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত আপনার অভিনয় আছে?

উত্তর : না। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে আমার অভিনয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার স্বামীকে থাকতে হয়‌, তাই আমিও থাকি।

প্রশ্ন : আজ যখন শেষ অঙ্কে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

উত্তর; সাধারণ অভিনেত্রী মেয়েদের জন্যে একটা আলাদা সাজঘর আছে। আমি সেই সাজঘরে গায়ের মুখের রঙ সবেমাত্র তুলতে আরম্ভ করেছিলুম।

প্রশ্ন : সেখানে আর কেউ ছিল?

উত্তর : লক্ষ্য করিনি। একবার বোধহয় নন্দিতাদিদি ঘরে এসেছিল।

প্রশ্ন : আপনি কবে থেকে অভিনয় করছেন?

উত্তর : এই নাটকের আরম্ভ থেকে। প্রায় বছর ঘুরতে চলল।

প্রশ্ন : অভিনয়ের দিকে আপনার ঝোঁক আছে।

উত্তর : খুব বেশি নয়। আমার স্বামী চেয়েছিলেন‌, কিছু টাকাও আসছিল‌, তাই থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলুম।

প্রশ্ন : আপনি বোম্বাই কিম্বা মাদ্রাজে গিয়ে সিনেমায় অভিনয় করলে অনেক টাকা উপার্জন করতে পারতেন। করেননি কেন?

উত্তর : বাংলা দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আমি গোরস্থ ঘরের মেয়ে‌, ঘরকন্ন করতেই ভালবাসি। আমার মা সহমৃতা হয়েছিলেন।

0 Shares