প্রশ্ন : সহমৃতা! আজকালিকার দিনে–!
উত্তর : বাবা মারা যাবার এক ঘন্টা পরে মা হার্টফেল করে মারা যান।
প্রশ্ন : ও-বুঝেছি। আচ্ছা, বিশু পাল কেমন লোক ছিলেন?
উত্তর : খুব মিশুকে লোক ছিলেন। দরাজ হাত ছিল। সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন।
প্রশ্ন : মেয়েদের সঙ্গেও?
উত্তর : হ্যাঁ। কিন্তু কখনো কোনো রকম বেচাল দেখিনি।
ইন্সপেক্টর : আচ্ছা, এবার আপনি বাড়ি যান।
কাঞ্চন সিংহ। বয়স-২৬। জীবিকা—থিয়েটারের আলোকশিল্পীর সহকারী। ঠিকানা-মানিকতলা স্ট্রীটের একটি মেস।
নোট : লোকটির ভাবভঙ্গী একটু খ্যাপাটে গোছের; মাঝে মাঝে আবোল তাবোল এলোমেলো কথা বলে। কতখানি খাঁটি কতখানি অভিনয় বলা যায় না।
প্রশ্ন : আপনি হিপি, না বিটুলে, না অবধূত?
উত্তর : আজ্ঞে, আমি বাঙালী। দি আপনার সাজপোশাক বাঙালীর মত নয়। দাড়ি গোঁফও প্রচুর। কোনো কারণ আছে
উত্তর : আমার ভাল লাগে। তাছাড়া থিয়েটার করার সময় পরচুলো পরতে হয় না।
প্রশ্ন : আপনি এখানে আসার আগে কী কাজ করতেন?
উত্তর : বাউণ্ডুলে ছিলাম। বাপ কিছু টাকা রেখে গিয়েছিল, মেসে থাকতাম আর শখের থিয়েটার করতাম।
প্রশ্ন : তাহলে চাকরিতে ঢুকলেন কেন?
উত্তর : বাপের পয়সায় শাক-চচ্চড়ি খাওয়া চলে, রসগোল্লা খাওয়া চলে না।
প্রশ্ন : তাহলে রসগোল্লা খাওয়ার জন্যেই চাকরিতে ঢুকেছিলেন?
উত্তর : শুধু রসগোল্লা নয়, অন্য মতলবও ছিল। জানেন, আমি খুব ভাল অ্যাক্ট করতে পারি। শিবাজির পার্ট, ঔরঙ্গজেবের পার্ট প্লে করেছি। বিশুবাবু আমার চেহারা দেখে চাকরিতে নিলেন, কিন্তু কাজ দিলেন আলো জ্বালা আর আলো নেভানোর। যদি অভিনয় করতে দিতেন, আগুন ছুটিয়ে দিতাম।
প্রশ্ন : তা বটে। এখন বলুন দেখি, আলো নেভানোর সময় আপনি সুইচের কাছে ছিলেন না কোন?
উত্তর : আলো নেভানোর সময় সুইচবোর্ডে একজন লোকেরই দরকার হয়। মণীশদা ছিলেন, তাই আমি
প্রশ্ন : কোথায় ছিলেন?
উত্তর; মাথা ধরেছিল, তাই আমি অফিস ঘরে গিয়ে টেবিলে মাথা রেখে একটু বসে ছিলাম।
প্রশ্ন : স্টেজের ওপর খুন হল। অসময়ে প্লে বন্ধ হয়ে গেল, এসব কিছুই জানতে পারেননি?
উত্তর : এ-একটু ঝিমকিনি এসে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : আপনি নেশাভাঙ করেন?
উত্তর : নেশাভাঙ! নাঃ, পয়সা কোথায় পাব!
প্রশ্ন : কোন নেশা করেন?
উত্তর; এঁ-নেশা করি না-মাঝে মাঝে ভাঙি খাই। মানে—
প্রশ্ন : মানে মারিওয়ানা সিগারেট খান। কে যোগান দেয়? পান কোথায়?
উত্তর : যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। ঠেলাগাড়িতে পানের দোকানে। আপনার চাই?
ইন্সপেক্টর : আপনি এখন যেতে পারেন। মেস ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কলকাতাতেই থাকবেন।
দাশরথি চক্রবর্তী। বয়স-৪৫। জীবিকা-নাট্যাভিনয়। ঠিকানা-বেহালা। ভাল মানুষের মত ভাবভঙ্গী, কিন্তু কথা বলার ধরন সোজা নয়। সরলভাবে চোখ মিটমিট করে তাকায়, কিন্তু চোখের গভীরে প্রচ্ছন্ন দুষ্টতার ইঙ্গিত। লোকটি কমিক অ্যাকটর, খোঁচা দিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু খোঁচা বুঝতে একটু সময় লাগে।
প্রশ্ন : আপনি গোড়া থেকে বিশুবাবুর সঙ্গে ছিলেন?
উত্তর : ছিলাম। বিশুর সঙ্গে যথেষ্ট সদ্ভাবও ছিল। তাই বুঝতে পারছি না যাবার সময় সে আমাকে এমনভাবে দিয়ে মজিয়ে গেল কেন?
প্রশ্ন : সেটা কি রকম?
উত্তর : ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এত রাত্রে যদি ট্যাক্সি না পাই, পেটে কিল মেরে এখানেই শুয়ে থাকতে হবে।
ইন্সপেক্টর : আপনি বেহালায় থাকেন তো? কিছু ভাববেন না, আমি পুলিস ভ্যানে আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।
দাশরথি : ধন্যবাদ। এবার যত ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করুন।
প্রশ্ন : বিশু পালের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?
উত্তর : কারুর সঙ্গে আমার অসদ্ভাব নেই। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না।
প্রশ্ন : বিশু পালের কোনো শত্রু ছিল?
উত্তর : শত্রুর কথা শুনিনি। তবে কি জানেন, যেখানে মেয়েমানুষ সেখানেই গণ্ডগোল।
প্রশ্ন : তার মানে? সুলোচনার কথা বলছেন?
উত্তর : (ক্ষণেক নীরব থাকার পর) সুলোচনা খুব ভাল অভিনয় করে, কিন্তু সে খানদানি অ্যাকট্রেস নয়, গোরস্তঘরের মেয়ে। ব্রজদুলাল প্রথম ওকে-মানে-থিয়েটারে নিয়ে আসে। তারপর বিশুর সঙ্গে সুলোচনার জেটপাট হয়ে গেল
প্রশ্ন : ও-বুঝেছি। তা নিয়ে বিশুবাবুর সঙ্গে ব্রজদুলালবাবুর কোনো মনোমালিন্য হয়নি?
উত্তর : অমান হেরফের হামেশাই হয়ে থাকে, কেউ গায়ে মাখে না। কে যাবে কেউটে সাপের লেজ মাড়াতে।
প্রশ্ন : হুঁ। অন্য কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিশু পালের ঘনিষ্ঠতা ছিল?
উত্তর : তা কি করে জানিব। কেউ তো ঢাক পিটিয়ে এসব কাজ করে না। অবশ্য থিয়েটারে নানা রকম মেয়ের যাতায়াত আছে, কোন অ্যাকটরের কখন কোন মেয়ের ওপর নজর পড়বে কে বলতে পারে। এই যে দারোয়ান প্রভুনারায়ণের একটা বোন আছে—সোমরিয়া, উচকা বয়স, রূপও আছে। সে থিয়েটারে চাকরানীর কাজ করে; কারুর নজর এড়িয়ে চলা তার স্বভাব নয়। বিশুও সকাল বিকেল নিয়ম করে থিয়েটার তদারক করতে আসত–
প্রশ্ন : অৰ্থাৎ, সোমরিয়ার সঙ্গে বিশু পালেরি–?
উত্তর : ভগবান জানেন। তবে সুযোগ সুবিধে সবই ছিল।
প্রশ্ন : আচ্ছা, ওকথা যাক।–বিশু পালের সঙ্গে বাইরের কোনো লোকের শক্রতা ছিল?
উত্তর : এক থিয়েটারের অধিকারীর সঙ্গে অন্য থিয়েটারের অধিকারীর রেষারেষি থাকে। বিশুর থিয়েটার খুব ভাল চলছিল, অনেকের চোখ টাটিয়েছিল। একে যদি শক্রতা বলেন, বলতে পারেন।
প্রশ্ন : এবার নিজের কথা বলুন।
উত্তর : নিজের কথা আর কি বলব? ছেলেবেলা থেকে থিয়েটারে ঢুকেছি, অনেক ঘাটের জল খেয়েছি। স্ত্রীকে নিয়ে বেহালায় থাকি, ছেলে।পুলে নেই। বেশি উচ্চাশাও নেই। যেমনভাবে দিন কাটছিল তেমনিভাবে কেটে গেলেই খুশি থাকতাম। কিন্তু বিশু মরে গেল, ওর দল টিকবে কিনা কে জানে। হয়তো ভেঙে যাবে, তখন আবার অন্য দলে গিয়ে ভিড়তে হবে।