লোকটি ব্যাগ হাতে চলে যাবার পর প্রতুলবাবু বললেন, ‘বিশু পালের ছোট ভাই। ডাক্তারি করে।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘কিন্তু পসার ভাল নয়।’
‘না, কষ্টেসৃষ্ট চালায়। কি করে বুঝলেন?’
‘ভাবভঙ্গী পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বোঝা যায়।’
ঠিক সাড়ে ছাঁটার সময় পদাঁ উঠল, নাটক আরম্ভ হল। সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলবে। মাত্র তিনটি অঙ্ক!
গল্পটি মহাভারতের বিরাট পর্ব থেকে অপহৃত হলেও একেবারে মাছিমারা অনুকরণ নয়, যথেষ্ট মৌলিকতা আছে। বস্তুত নাটকের শেষ অঙ্কে ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছে, অর্থাৎ বর্তমান কালের কীচক বর্তমান কালের ভীমকে বধ করে দ্রৌপদীকে দখল করেছে। নাটকের চরিত্রগুলির অবশ্য আধুনিক নাম আছে, পাঠকের সুবিধার জন্যে পৌরাণিক নামই রাখা হল।
নাটকের অভিনয় হয়েছে উৎকৃষ্ট। ক্রূর নায়ক কীচকের ভূমিকায় বিশু পালের অভিনয় অতুলনীয়। দ্ৰৌপদীর চরিত্রে সুলোচনা নামী যশস্বিনী অভিনেত্রী চমৎকার অভিনয় করেছে; তাছাড়া ভীম অর্জুন সুদেষ্ণা উত্তরা প্রভৃতির চরিত্রও ভাল অভিনীত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই নাটকটিতে চিরন্তন মনুষ্য সমাজের বিচিত্র আলেখ্য যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ধমোপদেশ বা নীতিকথা শোনাবার চেষ্টা নেই।
প্রতুলবাবু পরমানন্দে থিয়েটার দেখছেন, ব্যোমকেশও আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। নাটক ক্রমশ তৃতীয় অঙ্কে এসে পৌঁছল। এবার চরম পরিণতি।
শেষ দৃশ্যটি হচ্ছে একটি শয়নকক্ষ। কক্ষে আসবাব কিছু নেই, কেবল একটি পালঙ্ক। এটি দ্ৰৌপদীর শয়নকক্ষ। ভীম পালঙ্কের ওপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, কীচক আসবে।
ইতিপূর্বে ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর পরামর্শ হয়েছে, দ্ৰৌপদী কীচককে তার ঘরে ডেকেছে। ভীম দ্ৰৌপদীর বদলে বিছানায় শুয়ে আছে, কীচক এলেই ক্যাঁক করে ধরবে।
নাটকের পরিসমাপ্তি এই রকম; ভীমের সঙ্গে কীচকের মল্লযুদ্ধ হবে; কীচক পরাজিত হয়ে মৃত্যুর ভান করে পালঙ্কের পায়ের কাছে পড়ে যাবে, ভীম তখন দ্ৰৌপদীকে ডাকতে যাবে। মিনিটখানেকের জন্যে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। তারপর অস্পষ্ট সবুজ আলো জ্বলবে। আস্তে আস্তে আলো উজ্জ্বল হবে। দ্ৰৌপদীকে নিয়ে ভীম ফিরে আসবে; কীচক ছুরি নিয়ে পিছন থেকে ভীমকে আক্রমণ করবে। ছুরিকাহত ভীম মরে যাবে। কীচক তখন পৈশাচিক হাস্য করতে করতে দ্ৰৌপদীকে পালঙ্কের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। যবনিকা।
এবার দৃশ্যের আরম্ভের দিকে ফিরে যাওয়া যাক। ভীম পালঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে; ঘরের আলো খুব উজ্জ্বল নয়, তবে অন্ধকারও নয়। কীচক পা টিপে টিপে প্রবেশ করল, পা টিপে টিপে পালঙ্কের কাছে গেল। তারপর এক ঝটিকায় চাদর সরিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
যিনি ভীম সেজেছেন তাঁর বপুটিও কম নয়, শালপ্ৰাংশু মহাভুজ। কীচক পরম কমনীয়া যুবতীর পরিবর্তে এই ষণ্ডামার্কা পালোয়ানকে দেখে ক্ষণকালের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেল, সেই ফাঁকে ভীম দাঁত কড়মড় করে তাকে আক্রমণ করল। কীচকের পকেটে ছুরি ছিল (পরস্ত্রী লোলুপ লম্পটেরা নিরস্ত্রভাবে অভিসারে যায় না) কিন্তু সে তা বের করবার অবকাশ পেল না। দু’জনে ঘোর মল্লযুদ্ধ বেধে গেল।
স্টেজের ওপর এই মরণাস্তক কুস্তি সত্যিই প্রেক্ষণীয় দৃশ্য। মনে হয় না এটা অভিনয়। যেন দুটো ক্ষ্যাপা মোষ শিং-এ শিং আটকে যুদ্ধ করছে; একবার এ ওকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, একবার ও একে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। লোমহর্ষণ লড়াই। শুধু এই লড়াই দেখবার জন্যেই অনেক দর্শক আসে।
শেষ পর্যন্ত কীচকের পরাজয় হল, ভীম তাকে পালঙ্কের পাশে মাটিতে ফেলে বুকে চেপে বসে তার গলা টিপতে শুরু করল। কীচকের হাত-পা এলিয়ে পড়ল, জিভ বেরিয়ে এল, তারপর সে মরে গেল।
ভীম তার বুক থেকে নেমে চোখ পাকিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলল, ঘাড় চুলকে ভাবল, শেষে স্টেজ থেকে বেরিয়ে দ্রৌপদীকে খবর দিতে গেল।
ভীম নিষ্ক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্টেজ ও প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার হয়ে গেল। এই নাটকে আলোর কৌশলে গল্পের নাটকীয়তা বাড়িয়ে দেবার নৈপুণ্য ভারি চমকপ্রদ। শেষ অঙ্কের চরম মুহুর্তে মূল সম্পূর্ণ ভিয়ে দিয়ে পরিচালক বিত্ত পাল দর্শকের মান উৎকণ্ঠ ও আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মিনিটখানেক পরে দপ করে আবার সব আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল কীচক পূর্ববৎ খাটের খুরোর কাছে পড়ে আছে।
দ্ৰৌপদীকে নিয়ে ভীম প্রবেশ করল। ভীমের ভাবভঙ্গীতে উদ্ধত বিজয়োল্লাস, দ্ৰৌপদীর মুখে উদ্বেগ। তাদের মধ্যে হ্রস্বকণ্ঠে যে সংলাপ হল তা সংক্ষেপে এই রকম–
দ্ৰৌপদী : এখন মড়া নিয়ে কী করবে?
ভীম : কিছু ভেবো না, শেষ রাত্রে মড়া রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসব। নাটকের নির্দেশ, এই সময় কীচক মাটি থেকে চুপি চুপি উঠে। ভীমের পিঠে ছুরি মারবে। কিন্তু কীচক যেমন পড়েছিল তেমনি পড়ে রইল, নড়ন চড়ন নেই। ছুরি মারার শুভলগ্ন অতিক্রম হয়ে যাবার পর ভীম উসখুসি করতে লাগল, দুচারটে সংলাপ বানিয়ে বলল, কিন্তু কোনো ফল হল না। ভয়ানক সত্য আবিষ্কার করল প্রথমে দ্ৰৌপদী। শঙ্কিত মুখে কীচকের কাছে গিয়ে সে চীৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘অ্যাঁ-একি! একি–!’
কীচক অর্থাৎ বিশু পাল সত্যি সত্যিই মরে গেছে।
৩
নাটক শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে যবনিকা পড়ে গেল। যেসব দর্শকেরা আগে নাটক দেখেছিল তারা বিস্মিত হল, যারা দেখেনি তারা ভাবল এ আবার কি! কিন্তু কেউ কোনো গোলমাল না করে যে যার বাড়ি চলে গেল।
থিয়েটারের অন্দর মহলে তখন কয়েকজন মানুষ স্টেজের ওপর, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। কেবল দ্রৌপদী অর্থাৎ সূলোচনা নামী অভিনেত্রী মূৰ্ছিত হয়ে কীচকের পায়ের কাছে পড়ে ছিল। দারোয়ান প্রভুনারায়ণ সিং দরজা ছেড়ে স্টেজের উইংসে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চোখে মৃত কীচকের পানে চেয়ে ছিল।