স্টেজের দরজা অরক্ষিত পেয়ে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুকে নিয়ে ঢুকে পড়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়, গুরুতর কিছু ঘটেছে সন্দেহ নেই; সুতরাং অনুসন্ধান দরকার।
স্টেজ থেকে তীব্র আলো আসছে। একটি লোক ব্যাগ হাতে বেরিয়ে দোরের দিকে যাচ্ছিল, প্রতুলবাবু তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে, ডাক্তার পাল?’
অমল পাল, যে প্লে আরম্ভ হবার আগে তাদের পাশে গিয়ে বসেছিল, উদভ্ৰান্তভাবে বলল, ‘দাদা নেই, দাদা মারা গেছেন।’
‘মারা গেছেন? কী হয়েছিল?’
‘জানি না, বুঝতে পারছি না। আমি পুলিসে খবর দিতে যাচ্ছি।’ অমল পাল দোরের দিকে পা বাড়াল।
এবার ব্যোমকেশ কথা কইল, ‘কিন্তু—আপনি বাইরে যাচ্ছেন কেন? যতদূর জানি এখানে টেলিফোন আছে।’
অমল পাল থমকে ব্যোমকেশের পানে চাইল, ধন্ধলাগাভাবে বলল, ‘টেলিফোন! ইহ্যাঁ হ্যাঁ, আছে বটে অফিস ঘরে—’
এই সময় দারোয়ান প্রভুনারায়ণ সিং এসে দাঁড়াল। লম্বা চওড়া মধ্যবয়স্ক লোক, থিয়েটারের পিছন দিকে কয়েকটা কুঠুরিতে সপরিবারে থাকে আর থিয়েটার বাড়ি পাহারা দেয়। সে অমল পালের পানে চেয়ে ভারী গলায় বলল, ‘সাব, মালিক তো গুজর গিয়ে। আব্র ক্যা করন হ্যায়?’
অমল পাল একটা ঢোক গিলে প্রবল বাম্পোচ্ছাস দমন করল, কোনো উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের উদ্দেশ্যে অফিস ঘরের দিকে চলে গেল। প্রভু সিং ব্যোমকেশের পানে চাইল, ব্যোমকেশ বলল, ‘তুমি দারোয়ান? বেশ, দোরে পাহারা দাও। পুলিস যতক্ষণ না আসে কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দিও না।’
প্রভু সিং চলে গেল। সে সচ্চরিত্র প্রভুভক্ত লোক; তার সংসারে স্ত্রী আর একটি বিধবা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। বস্তুত থিয়েটারই তার সংসার। বিশেষত অভিনেত্রী জাতীয়া স্ত্রীলোকদের সে একটু বেশি স্নেহ করে। এই তার চরিত্রের একটি দুর্বলতা; কিন্তু নিঃস্বার্থ দুর্বলতা।
ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু যখন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন তখন তিনজন পুরুষ দ্রৌপদীকে অর্থাৎ অভিনেত্রী সুলোচনাকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গ্ৰীনরুমে যাচ্ছে। তারা চলে গেলে স্টেজে রয়ে গেল দু’টি লোক : একটি ছেলেমানুষ গোছের মেয়ে, সে উত্তরার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল; সে পালঙ্কের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে বিভীষিকা-ভরা চোখে মৃত বিশু পালের মুখের পানে চেয়ে ছিল। সে এখনো উত্তরার সাজ-পোশাক পরে আছে, তার মোহাচ্ছন্ন অবস্থা দেখে মনে হয়। সে আগে কখনো অপঘাত মৃত্যু দেখেনি। তার নাম মালবিকা।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যুবাপুরুষ, সে পালঙ্কের শিয়রের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল এবং ক্রমান্বয়ে একবার মৃতের মুখের দিকে একবার মেয়েটির মুখের পানে চোখ ফেরাচ্ছিল। তার খেলোয়াড়ের মত দৃঢ় সাবলীল শরীর এবং সংযত নিরুদ্বেগ ভাব দেখে মনে হয় না যে সে এই থিয়েটারে আলোকশিল্পী। তার নাম মণীশ, বয়স আন্দাজ ত্ৰিশ।
ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু স্টেজে প্রবেশ করে পালঙ্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মৃতের মুখে তীব্র আলো পড়েছে। মুখে মৃত্যু যন্ত্রণার ভান সত্যিকার মৃত্যু যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। কিম্বা–
‘মুখের কাছে ওটা কী?’ প্রতুলবাবু মৃতের মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে খাটো গলায় প্রশ্ন করলেন।
ব্যোমকেশ সামনের দিকে ঝুকে দেখল, রুমালের মত এক টুকরো কাপড় বিশু পালের চোয়ালের কাছে পড়ে আছে। সে বলল, ‘ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রুমাল নয়। যখন লড়াই হচ্ছিল তখন ওটা চোখে পড়েনি।’
‘আমারও না।’
ব্যোমকেশ সোজা হয়ে বলল, ‘কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?’
‘গন্ধ? প্রতুলবাবু দু’বার আত্মাণ নিয়ে বললেন, ‘সেন্ট-পাউডার, ম্যাকস ফ্যাকটর, সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ। আর তো কিছু পাচ্ছি না।’
পাচ্ছেন না? এইদিকে ঝুকে একটু ওঁকে দেখুন তো। ‘ ব্যোমকেশ মৃতদেহের দিকে আঙুল দেখাল।
প্রতুলবাবু সামনে ঝুকে কয়েকবার নিশ্বাস নিলেন, তারপর খাড়া হয়ে ব্যোমকেশের সঙ্গে মুখোমুখি হলেন, ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন। বাদাম তেলের ক্ষীণ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে—‘
যারা সুলোচনাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তারা ফিরে এল। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে ব্রজদুলাল, অর্থাৎ ভীম; দ্বিতীয় ব্যক্তিটি থিয়েটারের প্রমপটার, নাম কালীকিঙ্কর; তৃতীয় ব্যক্তির নাম দাশরথি, সে কমিক অভিনেতা, নাটকে বিরাটরাজার পার্ট করেছে।
তিনজনে অস্বস্তিপূর্ণভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল; মাঝে মাঝে মৃতদেহের পানে তাকাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। ভীমের হাতে তার ব্যাগ ছিল (পরে দেখা গেল অভিনেতা অভিনেত্রীরা সকলেই বাড়তি কাপড়-চোপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে অভিনয় করতে আসে)। ভীম ব্যাগটি স্টেজের ওপর রেখে নিজে সেখানে বসল; ব্যাগ খুলে আস্ত একটা হুইস্কির বোতল ও গেলাস বার করল, একবার সকলের দিকে চোখ তুলে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘কেউ খাবে?
কেউ সাড়া দিল না। ভীম তখন গেলাসে খানিকটা মদ ঢেলে মালবিকার পানে চাইল। মালবিকার মুখ পাংশু, মনে হয় যেন তার শরীর অল্প অল্প টলছে। স্নায়ুর অবসাদ এসেছে, এখনি হয়তো মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে। ভীম মণীশকে বলল, ‘মণীশ, মালবিকার অবস্থা ভাল নয়, এই নাও, একটু জল মিশিয়ে খাইয়ে দাও। নইলে ও যদি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে, নতুন ঝামেলা শুরু হবে—‘
মণীশ তার হাত থেকে গেলাস নিয়ে বলল, ‘সুলোচনাদিদির জ্ঞান হয়েছে?’ ভীম বলল, ‘এখনো হয়নি। নন্দিতাকে বসিয়ে এসেছি। মণীশ, তুমি মালবিকাকে ওঘরে নিয়ে যাও। ওষুধটা জল মিশিয়ে খাইয়ে দিও, তারপর খানিকক্ষণ শুইয়ে রেখো। দশ মিনিট শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।’