বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত)

মণীশ এক হাতে মালবিকার পিঠ জড়িয়ে অন্য হাতে হুইস্কির গেলাস নিয়ে গ্ৰীনিরুমের দিকে চলে গেল! ভীম তখন নিজের পুরুন্টু গোঁফজোড়া ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে হুইস্কির বোতলের গলায় ঠোঁট জুড়ে চুমুক মারল।

আমাদের দেশের যাত্ৰা থিয়েটারে ভীমের ইয়া গোঁফ ও গালাপাট্টা দেখা যায়; যদিও মহাভারতে বেদব্যাস। ভীমকে তূরব বলেছেন। অর্থাৎ ভীম মাকুন্দ ছিল। অবশ্য বর্তমান নাটকে ভীম মাকুন্দ না হলেও ক্ষতি নেই; এ-ভীম সে-ভীম নয়‌, তার অর্বাচীন বিকৃত ছায়ামাত্র।

লম্বা এক চুমুকে প্রায় আধাআধি বোতল শেষ করে ভীম বোতল নামিয়ে রাখল‌, প্যাঁচার মত মুখ করে কিছুক্ষণ বোতলের পানে চেয়ে রইল। তার গোঁফ-বৰ্জিত মুখখানা অন্য রকম দেখাচ্ছে‌, ন্যাড়া হাড়গিলের মত। সে কতকটা নিজের মনেই বলল‌, ‘ভীম-কীচকের লড়াই-এর পর আমার রোজই এক গেলাস দরকার হয়‌, নইলে গায়ের ব্যথা মরে না। আজ এক বোতলেও শানাবে না।’

ব্যোমকেশ এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল‌, শুনছিল। এখন শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল‌, ‘বিশু পাল মদ খেতেন?’

বলল‌, না। ওরা দরকার হত না। লোহার শরীর ছিল। কিসে যে মারা গেল।–1 ডাক্তার অমলকে দেখেছিলাম‌, সে কোথায় গেল?’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘তিনি পুলিসকে টেলিফোন করতে অফিসে গেছেন। পুলিস এখনি এসে পড়বে। তার আগে আমি আপনাদের দু’ একটা প্রশ্ন করতে পারি?

ভীম বোতলে আর এক চুমুক দিয়ে বলল‌, ‘করুন প্রশ্ন। আপনি কে জানি না‌, কিন্তু প্রশ্ন করার হক সকলেরই আছে।’

প্রতুলবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন‌, ‘ইনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী। থিয়েটার দেখতে এসেছিলাম একসঙ্গে‌, তারপর এই দুর্ঘটনা।’

ভীমের চোখের দৃষ্টি একটু সতর্ক হল‌, অন্য দু’জন ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ব্যোমকেশ বলল‌, ‘আজ আপনারা এখানে ক’জন উপস্থিত আছেন?’।

ভীম বলল‌, ‘শেষ দৃশ্য অভিনয় হচ্ছিল। সাধাণরত শেষ দৃশ্যে যাদের কোজ নেই তারা বাড়ি চলে যায়। আজ বিশু সুলোচনা আর আমি ছিলাম। আর কারা ছিল না ছিল খবর রাখি না।’

কমিক অভিনেতা দাশরথি বলল‌, ‘আমি আর আমার স্ত্রী নন্দিতা ছিলাম।’

ব্যোমকেশ সপ্রশ্ন নেত্রে চাইল। দাশরথির এখন কমিক ভাব নেই‌, চোখে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি। সে ইতস্তত করে বলল‌, ‘বিশুবাবুর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল‌, তাই নাটক শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম। তৃতীয় অঙ্কে আমার প্রবেশ নেই।’

‘আর কেউ ছিল?’

‘আর মালবিকা ছিল। টেকনিশিয়ানদের মধ্যে মণীশ আর তার সহকারী কাঞ্চনজঙ্ঘা ছিল–’

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা!’

‘তার নাম কাঞ্চন সিংহ‌, সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে।’

‘ও‌, তিনি কোথায়?’

দাশরথি এদিক ওদিক চেয়ে বলল‌, ‘দেখছি না। কোথাও পড়ে ঘুম দিচ্ছে বোধহয়।’

‘আর কেউ?’ এতক্ষণে তৃতীয় ব্যক্তি কথা বলল‌, ‘আর আমি ছিলাম। আমি প্রমপটার‌, শেষ পর্যন্ত নিজের জায়গায় ছিলাম।’

‘আপনার জায়গা কোথায়?’

প্রমপটার কালীকিঙ্কর দাস। আঙুল দেখিয়ে বলল‌, ‘ওই যে উইংসের খাঁজের মধ্যে টুল পাতা রয়েছে‌, ঐখানে।’

স্টেজের ওপর যে ঘরের সেট তৈরি হয়েছিল তার প্রবেশদ্বার মাত্র দু’টি : একটি পিছনের দেয়ালে‌, অন্যটি বাঁ পাশে; কিন্তু প্রসিনিয়ামের দু’পাশে থেকে এবং আরো কয়েকটি উইংসের প্রচ্ছন্ন পথে যাতায়াত করা যায়। প্রমপটার যেখানে দাঁড়ায় সেখানে যাওয়া আসার সঙ্কীর্ণ পথ আছে; বিপরীত দিকে আলোর কলকব্জা ও সুইচ বোর্ড যেখানে দেয়ালের সারা গায়ে বিছিয়ে আছে সেদিক থেকে স্টেজে প্রবেশের সোজা রাস্তা। আলোকশিল্পীকে সর্বদা স্টেজের ওপর চোখ রাখতে হয়‌, মাঝখানে আড়াল থাকলে চলে না।

এই সময় পিছনের দরজা দিয়ে মণীশ মালবিকার বাহু ধরে স্টেজে প্রবেশ করল। মালবিকার ফ্যাকাসে মুখে একটু সজীবতা ফিরে এসেছে। ওরা মৃতদেহের দিকে চোখ ফেরাল না। মণীশ বলল‌, ‘ব্রজদুলালদা‌, এই নিন। আপনার গেলাস। মালবিকা এখন অনেকটা সামলেছে‌, ওকে এবার বাড়ি নিয়ে যাই?’

ভীম বলল‌, ‘এখনি যাবে কোথায়! এখনো পুলিস আসেনি।’

মণীশ সপ্রশ্ন চোখে ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবুর পানে চাইল। ব্যোমকেশ মাথা নাড়ল‌, ‘আমরা পুলিস নই। কিন্তু আপনাকে তো অভিনয় করতে দেখিনি—’

ভীম বলল‌, ‘ও অভিনয় করে না। ও আমাদের আলোকশিল্পী। মণীশ ভদ্র’র নাম শুনেছেন নিশ্চয়-বিখ্যাত সাঁতারু।’

মণীশ বলল‌, ‘আপনিও কম বিখ্যাত নন‌, ব্রজদুলালদা। এক সময় ভারতবর্ষের চ্যাম্পিয়ন মিড়ল-ওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন।’

ভীম গোলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলল‌, ‘সে-সব দিন গেছে ভায়া। বোসো বোসো‌, আজ রাত দুপুরের আগে কেউ ছাড়া পাচ্ছে না।’

মণীশ বলল‌, ‘কিন্তু কেন? পুলিস আসবে কেন? বিশুবাবুর মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়? আমার তো মনে হয় ওঁর হার্ট ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়েছিল‌, লড়াই-এর ধকল সহ্য করতে পারেননি‌, হার্ট ফেল করে গেছে।’

ভীম বলল‌, ‘যদি তাই হয় তবু পুলিস তদন্ত করবে।’

মণীশ আর মালবিক পাশাপাশি স্টেজের ওপর বসল। কিছুক্ষণ কোনো কথা হল না। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ঠিক নেই; কমিক অভিনেতা দাশরথি ওরফে বিরাটরাজ পকেট থেকে সিগারেট বার করে মৃতদেহের পানে কটাক্ষপাত করে সিগারেট আবার পকেটে পুরল।

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘আচ্ছা‌, একটা কথা। মণীশবাবু এবং শ্ৰীমতী মালবিকা হলেন স্বামী-স্ত্রী-কেমন? ওঁরা একসঙ্গে এই থিয়েটারে কাজ করেন। এই রকম স্বামী-স্ত্রী এ থিয়েটারে আরো আছেন নাকি?’

ভীম গেলাসে এক চুমুক দিয়ে বলল‌, ‘দেখুন‌, আমাদের এই থিয়েটার হচ্ছে একটি ঘরোয়া কারবার। যারা এখানে কাজ করে‌, মেয়ে-মদ কাজ করে। যেমন মণীশ আর মালবিকা‌, বিশু আর সুলোচনা‌, দাশরথি আর নন্দিতা। আমি অ্যাকটিং করি‌, আমার স্ত্রী শান্তি মিউজিক মাস্টার-গানে সুর বসায়। শাস্তির কাজ শেষ হয়েছে‌, সে রোজ আসে না। আজ আসেনি। এমনি ব্যবস্থা। ছুট্‌ লোক বড় কেউ নেই।’

0 Shares