বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত)

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘বুঝলাম। এখন বলুন দেখি‌, বিশুবাবু মানুষটি কেমন ছিলেন?’

ভীম মদের গেলাস মুখে তুলল। দাশরথি উত্তেজিত হয়ে বলল‌, ‘সাধু ব্যক্তি ছিলেন। উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন‌, মুক্তহস্ত পুরুষ ছিলেন। তিনি যেমন অগাধ টাকা রোজগার করতেন তেমনি দুহাতে টাকা খরচ করতেন। মণীশকে নতুন মোটর কিনে দিয়েছিলেন‌, আমাদের সকলের নামে লাইফ ইনসিওর করেছিলেন। নিজে প্রিমিয়াম দিতেন। এ রকম মানুষ পৃথিবীতে কটা পাওয়া যায়?’

ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে বলল‌, ‘তাহলে বিশুবাবুর মৃত্যুতে আপনাদের সকলেরই লাভ হয়েছে।’ একথার উত্তরে হঠাৎ কেউ কিছু বলতে পারল না‌, মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শেষে ভীম বলল‌, ‘তা বটে। বিশু নিজের নামে জীবনবীমা করেছিল‌, কিন্তু উত্তরাধিকারী করেছিল আমাদের। তার মৃত্যুতে বীমার টাকা আমরাই পাব। কিন্তু সামান্য কাটা টাকার জন্যে বিশুকে খুন করবে। এমন পাষণ্ড এখানে কেউ নেই।’

‘তাহলে বিশুবাবুর শত্ৰু কেউ ছিল না?’

কেউ উত্তর দেবার আগেই বাঁ দিকের দোর দিয়ে ডাক্তার অমল পাল প্রবেশ করল। তার পিছনে একটি হিপি-জাতীয় ছোকরা। মাথার চুলে কপোল ঢাকা‌, দাড়ি গোঁফে মুখের বাকি অংশ সমাচ্ছন্ন; আসলে মুখখানা কেমন বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় না। সে মৃতদেহের দিকে একটি বঙ্কিম কটাক্ষ নিক্ষেপ করে চুপিচুপি মণীশদের পাশে গিয়ে বসল।

দাশরথি বলল‌, ‘এই যে কাঞ্চনজঙ্ঘা! কোথায় ছিলে হে তুমি?’

কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন শুনতে পায়নি এমনিভাবে মণীশকে খাটো গলায় বলল‌, ‘ভীষণ মাথা ধরেছিল‌, মণীশদা। থার্ড অ্যাকটে আমার বিশেষ কোজ নেই‌, তাই সিন ওঠার পর আমি কলঘরে গিয়ে মাথায় খুব খানিকটা জল ঢালিলাম। তারপর অফিস ঘরে গিয়ে পাখাটা জোরে চালিয়ে দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে একটু চোখ বুজেছিলাম। অফিসে কেউ ছিল না‌, তাই বোধহয় একটু ঝিমকিনি এসে গিয়েছিল—’

মণীশ বিরক্ত চোখে তার পানে চাইল। দাশরথি বলল‌, ‘এত কাণ্ড হয়ে গেল কিছুই জানতে পারলে না।

এবারও কাঞ্চনজঙ্ঘা কোনো কথায় কৰ্ণপাত না করে মণীশের কাছে আরো খাটো গলায় বোধকরি নিজের কার্যকলাপের কৈফিয়ৎ দিতে লাগল।

ব্যোমকেশ হঠাৎ গলা চড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করল‌, ‘আপনার জন্যে বিশুবাবু কত টাকার বীমা করে গেছেন?’

কাঞ্চনজঙ্ঘা চকিতভাবে মুখ তুলল‌, ‘আমাকে বলছেন? বীমা! কই‌, আমার জন্যে তো বিশুবাবু জীবনবীমা করেননি।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘করেননি? তবে যে শুনলাম–’

ভীম বলল‌, ‘ওর চাকরির এক বছর পূর্ণ হয়নি‌, প্ৰেবেশনে কাজ করছে‌, কাঁচা চাকরি—তাই—‘

কাছেই প্রতুলবাবু ও অমল পাল দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে কথা বলছিলেন‌, ব্যোমকেশ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আর কোনো প্রশ্ন না করে সেইদিকে ফিরল। অমল পাল অস্বস্তিভরা গলায় বলছিল‌, ‘দাদার সঙ্গে সুলোচনার ঠিক—মনে—ওরা অনেকদিন স্বামী-স্ত্রীর মতাই ছিল—’

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল‌, ‘বিশুবাবু বিয়ে করেননি?’

‘করেছিলেন বিয়ে। কিন্তু অল্পকাল পরেই বৌদি মারা যান। সে আজ দশ বারো বছরের কথা। ছেলেপুলে নেই।’

স্টেজের দোরের বাইরে মোটর হর্ন শোনা গেল। একটা পুলিস ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে। আট দশজন পোষাকী পুলিস ভ্যান থেকে নেমে প্রভু সিং-এর সঙ্গে কথা বলল। তারপর পিলপিল করে স্টেজে ঢুকল। একজন অফিসার ব্যোমকেশদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন‌, ‘আমি ইন্সপেক্টর মাধব মিত্ৰ, থানা থেকে আসছি। কে টেলিফোন করেছিলেন?’

‘আমি-ডক্টর অমল পাল। আমার দাদা—’

‘কি ব্যাপার সংক্ষেপে বলুন।’

অমল পাল স্খলিত স্বরে আজকের ঘটনা বলতে আরম্ভ করলেন‌, ইন্সপেক্টর মাধব মিত্র ঘাড় একটু কাত করে শুনতে শুনতে স্টেজের চারিদিকে চোখ ফেরাতে লাগলেন; মৃতদেহ থেকে প্রত্যেক মানুষটি তাঁর দৃষ্টি প্রসাদে অভিষিক্ত হল। বিশেষত তাঁর অনুসন্ধিৎসু চক্ষু প্রতুলবাবু ও ব্যোমকেশের পাশে বারবার ফিরে আসতে লাগল। মাধব মিত্রের চেহারা ভাল‌, মুণ্ডিত মুখে চতুর্য ও সতর্কতার আভাস পাওয়া যায়; তিনি কেবলমাত্র তাঁর উপস্থিতির দ্বারা যেন সমস্ত দায়িত্বের ভার নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন।

ডাক্তার পালের বিবৃতি শেষ হলে ইন্সপেক্টর বললেন‌, ‘মৃতদেহ সরানো হয়নি?’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘না। কাউকে কিছুতে হাত দিতে দেওয়া হয়নি। যাঁরা ঘটনাকালে মঞ্চে ছিলেন তাঁরাও সকলেই উপস্থিত আছেন।’

ইন্সপেক্টর ব্যোমকেশের পানে চেয়ে প্রশ্ন করলেন‌, ‘আপনারা-?’ তিনি বোধহয় অনুভব করেছিলেন যে এঁরা দু’জন থিয়েটার সম্পর্কিত লোক নন।

প্রতুলবাবু ব্যোমকেশের পরিচয় দিলেন‌, সহজাত বিনয়বশত নিজের পরিচয় উহ্য রাখলেন। মাধব মিত্রের মুখ এতক্ষণ হাস্যহীন ছিল‌, এখন ধীরে ধীরে তাঁর অধর-প্রান্তে একটু মোলায়েম হাসি দেখা দিল। তিনি বললেন‌, ‘আপনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! আপনার যে থিয়েটার দেখার শখ আছে তা জানতাম না।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘আর বলেন কেন‌, পণ্ডিত ব্যক্তির পাল্লায় পড়ে এই বিপত্তি। ইনি হলেন–’

ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর পরিচয় দিল। তারপর বলল‌, ‘মাধববাবু্‌, আমরা মৃতদেহের কাছে একটা গন্ধ পেয়েছি। এই বেলা আপনি সেটা শুকে নিলে ভাল হয়। গন্ধটা বোধহয় স্থায়ী গন্ধ নয়?

মাধববাবু তুরিতে ফিরে মৃতদেহের কাছে গেলেন‌, একবার তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে পাশে নতজানু হয়ে সামনের দিকে ঝুকে মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন।

‘বিশ্বাস‌, শীগগির ডাক্তার ডেকে নিয়ে এস।’–মাধব মিত্র উঠে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশের দিকে ফিরলেন। তরুণ সাব-ইন্সপেক্টর বিশ্বাস প্রায় দৌড়তে দৌড়তে বাইরে চলে গেল। পুলিসের ডাক্তার পুলিস ভ্যানে অপেক্ষা করছিলেন।

0 Shares