বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত)

‘আপনারা ঠিক ধরেছেন‌, গন্ধটা সন্দেহজনক।–এই যে ডাক্তার‌, একবার এদিকে আসুন তো—‘

ব্যাগ হাতে প্রৌঢ় ডাক্তার মৃতের কাছে গেলেন‌, মাধবাবু ক্ষিপ্রস্বরে তাঁকে ব্যাপার বুঝিয়ে দিয়েন।

পাঁচ মিনিট পরে শিব পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন।

‘খুব ক্ষীণ গন্ধ‌, কিন্তু সায়ানাইড সন্দেহ নেই। এখনি মর্গে নিয়ে গিয়ে ওটপ্সি করতে হবে‌, নইলে সায়ানাইডের সব লক্ষণই লুপ্ত হয়ে যাবে।’

‘সায়ানাইড কি করে প্রয়োগ করা হল‌, ডাক্তার?’

ডাক্তার মৃতের কাছ থেকে ন্যাকড়ার ফালিটা তুলে ধরে বললেন‌, ‘এই কাপড়ের এক কোণে গিট বাঁধা রয়েছে দেখছেন? ওর মধ্যে কাচের একটা অ্যামপুল ছিল‌, তার মধ্যে তরল সায়ানাইড ছিল। যখন স্টেজ অন্ধকার হয়ে যায়। সেই সময় আততায়ী স্টেজে ঢুকে ন্যাকড়ার খুঁট ধরে মাটিতে আছাড় মারে‌, অ্যামপুল ভেঙ্গে যায়। তারপর-বুঝেছেন? হায়ড্রোসায়নিক অ্যাসিড খুব ভোলাটাইল-মানে–’

‘বুঝেছি। —মাধব মিত্র হাত নেড়ে পরিচরদের হুকুম দিলেন। তারা কীচকের মরদেহ ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে গেল। ডাক্তার ন্যাকড়ার ফালি ব্যাগে পুরে কীচকের অনুগামী হলেন।

অমল পালের গলার মধ্যে একটা চাপা শব্দ হল‌, যেন সে প্রবল কান্নার বেগ রোধ করবার চেষ্টা করছে।

মাধব মিত্র একবার চারিদিকে তাকালেন‌, ভীম প্রমুখ কয়েকটি লোক স্টেজের মধ্যে প্রস্তর পুত্তলিকার মত বসে আছে। ভীমের বোতল ব্যাগের মধ্যে অস্তহিঁত হয়েছে। মালবিকার চোখে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি। মাধব মিত্র ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন‌, ‘আজ বোধহয় এজাহার নিতে রাত কাবার হয়ে যাবে। আপনাদের অতক্ষণ আটকে রাখব না। কী দেখেছেন বলুন।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘দেখলাম। আর কই। যা কিছু ঘটেছে অন্ধকারে ঘটেছে।’

প্রতুলবাবু বললেন‌, ‘যেমন তেমন অন্ধকার নয়‌, সূচীভেদ্য অন্ধকার। আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ ছিলাম।’

মাধববাবু নিশ্বাস ফেলে বললেন‌, ‘তাহলে আপনাদের আটকে রেখে লাভ নেই। আজ আসুন তবে। যদি কোনো দরকারী কথা মনে পড়ে। দয়া করে আমাকে স্মরণ করবেন। আচ্ছা‌, নমস্কার।

ব্যোমকেশের ইচ্ছে ছিল আরো কিছুক্ষণ থেকে পরিস্থিতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে‌, কিন্তু এ রকম বিদায় সম্ভাষণের পর আর থাকা যায় না। দু’জনে দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হলেন। ব্যোমকেশ যেতে যেতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ইন্সপেক্টর অমল পালের সঙ্গে কথা কইছেন।

দোরের কাছে প্রভু সিং দাঁড়িয়েছিল। ব্যোমকেশ লক্ষ্য করল‌, দোরের বাইরে থেকে একটি মেয়ে ব্যগ্র চক্ষে স্টেজের দিকে উঁকি মারছে। যুবতী মেয়ে‌, মুখশ্ৰী ভাল‌, শাড়ি পরার ভঙ্গী ঠিক বাঙালী মেয়ের মত নয়। ব্যোমকেশদের আসতে দেখে সে সুন্টু করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ব্যোমকেশ প্রভু সিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল‌, বলল‌, ‘ও মেয়েটি কে?’

প্রভু সিং একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল‌, ‘জি-ও আমার ছোট বোন সোমরিয়া। আমার কাছেই থাকে‌, থিয়েটারের কাজকর্ম করে‌, ঝটপট ঝাড়পৌঁছ-এই সব। মালিক ওকে খুব স্নেহ করতেন—

‘হুঁ, সধবা মেয়ে মনে হল। তোমার কাছে থাকে কেন?’

প্রভু সিং বিব্রত হয়ে বলল‌, ‘জি‌, ওর মরদের সঙ্গে বনিবনাও নেই‌, তাই আমি নিজের কাছে এনে রেখেছি।’

‘তোমার সংসারে আর কেউ আছে?’

‘জি‌, ঔরৎ আছে‌, বাচ্চা মেয়ে আছে। থিয়েটারের হাতার মধ্যেই আমরা থাকি।’

প্রতুলবাবুর মোটর রাস্তার ধারে পার্ক করা ছিল। সেইদিকে যেতে যেতে ব্যোমকেশ দেখল থিয়েটারের হাতার মধ্যে পুলিসের ভ্যান ছাড়াও আরো দু’টি মোটর দাঁড়িয়ে আছে। একটি সম্ভবত বিশু পালের গাড়ি, আকারে বেশ বড় বিলিতি গাড়ি, খুব নতুন নয়; অন্য গাড়িটি কার অনুমান করা শক্ত। ভীমের হতে পারে‌, যদি ভীমের গাড়ি থাকে; আমল পাল ডাক্তার‌, তার গাড়ি হতে পারে; কিম্বা মণীশ ভদ্র’র হতে পারে। বিশু পাল মণীশকে গাড়ি কিনে দিয়েছিল

এই সব চিন্তার মধ্যে ব্যোমকেশ অনুভব করল সে প্রতুলবাবুর গাড়িতে চড়ে বাড়ির দিকে ফিরে চলেছে। সে অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে‌, পাশের অন্ধকার থেকে প্রতুলবাবু বললেন‌, ‘আমি অন্ধকারের মধ্যে স্টেজের ওপর কিছু দেখিনি সত্য‌, কিন্তু মনে হয় কিছু শুনেছি।’

‘কি শুনেছেন?’ ব্যোমকেশ তাঁর দিকে ঘাড় ফেরাল।

‘একটা মিহি শব্দ।’

‘কি রকম মিহি শব্দ?

‘ঠিক বর্ণনা করে বোঝানো শক্ত। এই ধরুন মেয়ের হাত ঝাড়লে যেমন চুড়ির আওয়াজ হয়‌, সেই রকম।’

‘কাচের চুড়ি‌, না সোনার চুড়ি?’

‘তা বলতে পারি না। আপনি কিছু শুনতে পাননি?’

‘আমার কান ওদিকে ছিল না।’

পথে আর কোনো কথা হল না।

পরদিন সকাল আন্দাজ সাড়ে সাতটার সময় ব্যোমকেশ বসবার ঘরে খবরের কাগজটা মুখের সামনে উঁচু করে ধরে গত রাত্রের থিয়েটারের খুনের বিবরণ পড়ছিল। সত্যবতী সকালে বাড়ি ফিরেছে‌, ব্যোমকেশকে এক পেয়ালা চা খাইয়ে গড়িয়াহাটে বাজার করতে গেছে‌, ফিরে এসে ব্যোমকেশকে আর এক পেয়ালা চা ও প্রাতরাশ দেবে। বাড়িতে কেবল অজিত আছে।

অন্দরের দিকের দরজা থেকে অজিত উঁকি মোরল‌, দেখল ব্যোমকেশ মুখের সামনে কাগজের পদ তুলে দিয়ে খবর পড়ছে। অজিত নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে গুটি গুটি সদর দোরের দিকে অগ্রসর হল। সে প্রায় দোর পর্যন্ত পৌঁচেছে পিছন থেকে শব্দ হল‌, ‘সাত সকালে চলেছ কোথায়?’

ধরা পড়ে গিয়ে অজিত দাঁড়াল‌, ভারিক্কিভাবে বলল‌, ‘দরকারী কাজে বেরুচ্ছি‌, টুকে দিলে তো?’

ব্যোমকেশ কাগজ নামিয়ে বলল‌, ‘বই-এর দোকানের কাজ?’

গাম্ভীর্যবর্জন করে অজিত মুখ টিপে হাসল।

0 Shares