বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত)

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘তোমার কার্য-কলাপ গতিবিধি ক্রমেই সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। বিকাশকে ডেকে তোমার পিছনে টিকটিকি লাগাতে হবে দেখছি।’

‘সাত দিন ধৈর্য ধরে থাকে‌, তারপর আমি নিজেই সব বলব।’ অজিত বেরিয়ে গেল।

ব্যোমকেশ আবার কাগজ তুলে নিল। থিয়েটারে পুলিস প্রায় দেড়টা পর্যন্ত ছিল‌, থিয়েটারের আগাপস্তলা তন্ন তন্ন করেছে; থিয়েটার সংশ্লিষ্ট যাবতীয় স্ত্রী পুরুষের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। কেবল খ্যাতনামা অভিনেত্রী সুলোচনা শোকাভিভুত থাকার জন্য এজাহার দিতে পারেননি। লাশ রাত্রেই ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল‌, লাশ-পরীক্ষক ডাক্তার বলেন‌, মৃতের শ্বাসনালী ও ফুসফুসের মধ্যে সাইনোজেন গ্যাসের অস্তিত্র পাওয়া গিয়েছে‌, ওই ভয়ঙ্কর বিষই মৃত্যুর কারণ। মামলার পুলিস ইন-চার্জ ইন্সপেক্টর মাধব মিত্র মনে করেন‌, বিশু পালের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়‌, কেউ তাকে খুন করেছে। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই‌, পুলিস তৎপর আছে‌, শীঘ্রই আসামী ধরা পড়বে। ওকুস্থিলে অর্থাৎ প্রেক্ষাগৃহে ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু উপস্থিত ছিলেন। কাগজে সে কথারও উল্লেখ আছে।

বাইরে সত্যবতীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল‌, সে বাজার করে ফিরেছে। তার পিছনে প্রতুলবাবু দুহাতে দু’টি পরিপুষ্ট থলে নিয়ে আসছেন‌, মুখে একটু অপ্রতিভ হাসি। সত্যবতী ঘরে ঢুকে বলল‌, ‘ওগো‌, দ্যাখো কে এসেছেন। উনিও গড়িয়াহাটে বাজার করতে গিয়েছিলেন-ধরে নিয়ে এলুম।’

ব্যোমকেশ হেসে উঠে দাঁড়াল‌, বলল‌, ‘বাঃ‌, বেশ। —সত্যবতী ঝাঁকামুটের কাজটা আপনাকে দিয়েই করিয়ে নিয়েছে দেখছি।’

‘যাঃ‌, তা কেন? উনি নিজেই আমার হাত থেকে থলি কেড়ে নিলেন।–আপনারা বসে গল্প করুন‌, আমি চা তৈরি করে আনছি।’ নিজের থলি প্রতুলবাবুর হাত থেকে নিয়ে সত্যবতী ভেতরে চলে গেল।

প্রতুলবাবু নিজের থলিটি নামিয়ে রেখে ব্যোমকেশের সামনের চেয়ারে বসলেন, বললেন, ‘কাগজে কালকের কীচক বধের খবর পড়ছেন দেখছি। আমিও পড়েছি।–আচ্ছা‌, কাল থিয়েটার থেকে ফিরতে ফিরতে আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?’

‘কি কথা‌, চুড়ির ঝনৎকার?’

‘হ্যাঁ, কাল থেকে চিন্তাটা মনের পিছনে লেগে আছে‌, পুলিসকে একথা জানানো উচিত কিনা।’

ব্যোমকেশ একটু নীরব থেকে প্রশ্ন করল‌, ‘ঝনাৎকার শব্দ স্টেজ থেকে এসেছিল এ বিষয়ে আপনি ষোল আনা নিঃসংশয়?’

প্রতুলবাবু বললেন‌, ‘দেখুন‌, অন্ধকারে বসে থাকলে কোন দিক থেকে আওয়াজ আসছে সব সময় ধরা যায় না। তবু্‌, স্টেজ থেকে যে আওয়াজটা এসেছিল এ বিষয়ে আমি বারো আনা নিঃসংশয়।’

‘তাহলে পুলিসকে বলা উচিত। ওরা যদি তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়–‘

এই সময় সদর দোরের কাছ থেকে আওয়াজ এল‌, ‘আসতে পারি?’

ব্যোমকেশ মুখ তুলে বলল‌, ‘এস এস‌, রাখাল। তোমাদের কথাই হচ্ছিল।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘বসো। তোমার কি কাজকর্ম নেই‌, সকালবেলাই থানা ছেড়ে বেরিয়েছ যে!’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘কাজকর্ম টিমে। কাগজে আপনাদের দু’জনের নাম দেখলাম। আপনারা আমার এলাকার লোক‌, তাই ভাবলাম তদারক করে আসি।’

সত্যবতী ট্রের ওপর দু’ পেয়ালা চা ও রাশীকৃত চিড়ে ভাজা নিয়ে এল। রাখালবাবু বললেন‌, ‘বৌদি‌, আমিও আছি। আর এক পেয়ালা চাই।’

আর এক পেয়ালা চা এল। তিনজনে চায়ের অনুপনি সহযোগে চিড়ে ভাজা খেতে খেতে গত রাত্রির থিয়েটারী হত্যাকাণ্ডের আলোচনা করতে লাগলেন।

চিড়ে ভাজা নিঃশেষ হলে রাখালবাবু চায়ের পেয়ালায় অন্তিম চুমুক দিয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, এ পাড়ায় শালীচরণ দাস নামে কাউকে চেনেন?

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘শালীচরণ দাস! নামের একটা মহিমা আছে বটে। কিন্তু আমি চিনি না। কে তিনি?’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘বছর বারো আগে আমি এই থানাতেই সাব-ইন্সপেক্টর ছিলাম। তখন শালীচরণকে নিয়ে বেশ কিছুদিন হৈ চৈ চলেছিল।’

‘হৈ চৈ কিসের? কী করেছিলেন। তিনি?’

‘শালীকে খুন করেছিল।’

‘শালীচরণ শালীকে খুন করেছিল!’

‘এবং বিশু পালের সঙ্গে এই ঘটনার কিছু যোগাযোগ আছে।’

‘তাই নাকি! বল বল‌, শুনি। —প্রতুলবাবু্‌, আপনার গল্প শুনতে আপত্তি নেই তো?’

প্রতুলবাবু বললেন‌, ‘গল্প শুনতে কার আপত্তি হতে পারে? আমি এ পাড়ার পুরনো বাসিন্দা‌, শালীচরণ নামটা যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। আজ রবিবার‌, ভেবেছিলাম সকালবেলা একটু লেখাপড়া করব। তা গল্পই শোনা যাক।’

অতঃপর রাখালবাবু শালীচরণের অতীত কাহিনী বললেন। গল্প শুনে ব্যোমকেশ বলল‌, ‘শালীচরণ এখন কোথায়? জেল থেকে বেরিয়েছে?’

রাখালবাবু বললেন‌, ‘মাসখানেক হল। জেলখাটা কয়েদীদের খবরাখবর আমাদের রাখতে হয়—’

‘কোথায় আছে?’

‘নিজের বাড়ির একতলায় উঠেছিল। আজ কোথায় আছে জানি না। খোঁজ নিতে পারি।’

ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করে বলল‌, ‘আজ ছুটির দিন‌, একটু সত্যান্বেষণে বেরুলে কেমন হয়? শালীচরণ আমার মনোহরণ করেছে। যাবেন তার বাড়িতে তত্ত্ব-তল্লাশ নিতে?’

প্রতুলবাবু বললেন‌, ‘বেশ তো‌, চলুন না। আমি কখনো খুনী আসামী দেখিনি‌, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। উঠুন তাহলে। আমার গাড়ি রয়েছে‌, তাতেই যাওয়া যাক।’

তিনজনে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। রাখালবাবু ড্রাইভারকে পথ নির্দেশ করার জন্যে সামনের সিটে বসলেন।

যেতে যেতে ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল‌, ‘আচ্ছা‌, রাখাল‌, মাধব মিত্তিরকে তুমি চেন?’

রাখালবাবু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন‌, ‘চিনি। ওঁর সঙ্গে কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করেছি।’

‘লোকটি কেমন বল তো?’

রাখালবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন‌, ‘খুব হাঁশিয়ার কাজের লোক‌, আর ভারি মুখমিষ্টি। কিন্তু নিজের এলাকায় কাউকে নাক গলাতে দেন না।’

0 Shares