বিশুপাল বধ (অসমাপ্ত)

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর পানে চেয়ে একটু হাসল।

পাঁচ মিনিট পরে রাখালবাবুর নির্দেশ অনুসরণ করে মোটর একটি বাড়ির সামনে থামল। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তার ওপর ছোট দোতলা বাড়ি; বাড়ির গায়ে জীৰ্ণতার ছাপ পড়েছে। তিনজনে মোটর থেকে অবতীর্ণ হয়ে বাড়ির সদরে এসে দেখলেন দরজায় তালা ঝুলছে।

তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। বাড়িতে তালা লাগিয়ে শালীচরণ কোথায় গেল? বাজারে?

সদর দোরের মাথায় দোতলায় একটি অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি ব্যালকনি ছিল‌, এক ভদ্রলোক সেখান থেকে নীচে উঁকি মারলেন‌, ‘কাকে চান?’

নীচে তিনজন ঊর্ধ্বমুখ হলেন। রাখালবাবু বললেন‌, ‘শালী-মানে কালীচরণ দাস আছেন?’

ত্ৰিশঙ্কুর মত ভদ্রলোক বললেন‌, ‘না‌, তিনি বাইরে গেছেন।’

‘কোথায় গেছেন?’

দাঁড়ান‌, আমি আসছি।’ ত্রিশঙ্কু ব্যালকনি থেকে অদৃশ্য হলেন।

অল্পক্ষণ পরে বাড়ির পাশের দিক থেকে ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। মধ্যবয়স্ক লোক‌, কিন্তু ভাবভঙ্গীতে চটুলতার আভাস বয়সের অনুকুল নয়। বললেন‌, ‘আমি কালীচরণবাবুর ভাড়াটে। ওপরতলায় থাকি। আপনারা কি তাঁর বন্ধু?

ব্যোমকেশ হেসে বলল‌, ‘অন্তত শক্র নয়; দর্শনার্থী বলতে পারেন। তিনি কোথায়?’

ভদ্রলোক হাসি-হাসি মুখে বললেন‌, ‘তিনি বোষ্ট্রমীকে নিয়ে বৃন্দাবন গেছেন।’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলে বলল‌, ‘বৃন্দাবন! বোষ্টমী!’

ভদ্রলোকের মুখের হাসি আর একটু প্রকট হল‌, ‘আজ্ঞে। আমার বাসায় একটি কমবয়সী ঝি কাজ করত‌, দেখতে শুনতে ভাল‌, বোধহয় বিধবা। কাজকর্ম ভালই করছিল‌, তারপর কালীচরণবাবু জেল থেকে ফিরে এলেন। একলা মানুষ হলেও তাঁর একজন ঝি দরকার‌, চপল-মানে আমার ঝি তাঁর কাজও করতে লাগল। কিছুদিন যেতে না যেতেই চপলা আমার কাজ ছেড়ে দিল‌, কেবল কালীচরণবাবুর কাজ করে। তারপর দেখলাম চপলা গলায় কঠি পরে বৈষ্ণবী হয়েছে। ক্রমে সন্ধ্যার পর নীচের তলা থেকে খঞ্জনির আওয়াজ আসে; যুগল-কণ্ঠে গান শোনা যায়—হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে–

‘দিন দশেক আগে একদিন সন্ধ্যেবেলা কালীচরণবাবু এক থালা মালপো আর পরমান্ন নিয়ে দোতলায় এলেন‌, সলজ্জভাবে জানালেন চপলা বোষ্ট্রমীকে তিনি কঠি-বদল করে বিয়ে করেছেন।’

নিঃশব্দ হাসিতে ভদ্রলোকের মুখ ভরে গেল।

ব্যোমকেশ চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে বলল‌, ‘তাই তো। কবে বাইরে গেলেন?’

‘কাল সকালে।’

‘সকলে?’

‘আজ্ঞে। ভোরবেলা ওপরতলায় এসে আমাকে নীচের তলার চাবি দিয়ে বললেন‌, আমরা বৃন্দাবন যাচ্ছি। বেলা দশটার ট্রেনে‌, হাপ্ত দুই পরে ফিরব। এই বলে বোষ্টমীকে ট্যাক্সিতে তুলে চলে গেলেন। বৃন্দাবনে নাকি কোন আখড়ায় মোচ্ছব আছে।’

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল‌, প্রতুলবাবু বললেন‌, ‘এটা বোধহয় বৈষ্ণবীয় হনিমুন।’

তারপর রসিক ভদ্রলোকটিকে ধন্যবাদ ও নমস্কার জানিয়ে তিনজনে গাড়িতে এসে উঠলেন। প্রতুলবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন‌, ‘খুনী আসামী দেখা আমার ভাগ্যে নেই।’

পাঁচ-ছয় দিন বিশুপাল বধ সম্বন্ধে আর কোনো নতুন খবর পাওয়া গেল না; সংবাদপত্রে খবরটি প্রথম পৃষ্ঠা ছেড়ে অন্দরমহলে গা-ঢাকা দিয়েছে। মাধব মিত্রের সাড়াশব্দ নেই। ভাবগতিক দেখে মনে হয় তিনি মামলার কোনো কিনারা করতে পারেননি‌, আসামী এখনো অজ্ঞাত।

ব্যোমকেশের হাতে অন্য কোনো কাজ ছিল না‌, তাই তার মনটা থিয়েটারী হত্যার দিকে পড়ে থাকত। শনিবার বিকেলবেলা সে প্রতুলবাবুকে ফোন করবে। মনস্থ করেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। স্বয়ং প্রতুলবাবু ফোন করছেন। তিনি বললেন‌, ‘এইমাত্র ইন্সপেক্টর মাধব মিত্রের পরোয়ানা এসেছে। তিনি আমার বাসায় আসছেন। আপনাকেও হাজির থাকতে হবে। বোধহয় হালে পানি পাচ্ছেন না।’

ব্যোমকেশ বলল‌, ‘হুঁ। আপনি তাকে কঙ্কণ ঝনৎকারের কথা বলেছেন নাকি?’

না। তিনি এলে বলব।’

‘আর শালীচরণ দাসের রোমান্স?’

‘না‌, দরকার বোধ করেন। আপনি বলবেন।’

‘আচ্ছা‌, আমি এখনি বেরুচ্ছি।’

‘গাড়ি পাঠাব?

‘না না‌, দরকার নেই। দশ মিনিটের তো রাস্তা।’

‘গাড়ি থাকলে দু’ মিনিটে আসা যেত।’

ব্যোমকেশ হেসে বলল‌, ‘হুঁ। বুঝেছি আপনার ইঙ্গিত।’

পনেরো মিনিট পরে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর বাড়িতে দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসতে না বসতেই মাধব মিত্র উপস্থিত হলেন। তাঁর হাতে চামড়ার মোটা ফাইল। টেবিলের ওপর ফাইল রেখে তিনি বিনীত হাস্য করলেন‌, ‘বিরক্ত করতে এলাম। ভেবেছিলাম। আপনাদের কষ্ট দেব না‌, কিন্তু গরজ বড় বালাই। আপনারা সে-রত্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; যদিও চোখে কিছু দেখেননি‌, তবু আপনাদের উপস্থিতিই আমার কাছে মূল্যবান। আপনারা জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি‌, পরম পণ্ডিত। আপনাদের মানসিক সহযোগিতা পেলেই আমরা কৃতাৰ্থ হয়ে যাব।’

লোকটির মিষ্টি কথা বলবার ক্ষমতা আছে বটে; কিন্তু ব্যোমকেশও হার মানবার পাত্র নয়। সে বলল‌, ‘সে কি কথা! পুলিসকে সাহায্য করা তো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। তাছাড়া আপনি যে রকম মিষ্টভাষী সজন ব্যক্তি আপনাকে সাহায্য করা তো গৌরবের কথা। আমরা কি করতে পারি বলুন। সে-রত্রে থিয়েটার থেকে চলে আসার পর কী ঘটেছিল। আমরা কিছুই জানি না; খবরের কাগজে যা পড়েছি তা ধর্তব্য নয়। এইটুকু শুধু জানি যে অজ্ঞাত আসামী এখনো সনাক্ত হয়নি।’

প্রতুলবাবু ইতিমধ্যে চা ফরমাস করেছিলেন‌, সঙ্গে এক প্লেট প্যাস্ট্রি। মাধববাবু এক চুমুক চা খেয়ে প্যাস্ট্রিতে কামড় দিলেন‌, চিবোতে চিবোতে বললেন‌, ‘না‌, সনাক্ত হয়নি। তবে জাল খানিকটা গুটিয়ে এনেছি। ঘটনাকালে যে দশজন মঞ্চে উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে ছাঁটাই করে গুটি তিনেক লোককে দাঁড় করানো গেছে। মুশকিল কি হয়েছে জানেন‌, ওদের সকলেরই একটা না একটা মোটিভ আছে। তাহলে গোড়া থেকে বলি শুনুন–

0 Shares