বেণীসংহার

‘বুড়োর অগাধ টাকা। ছেলে এবং মেয়েকে মাসহারা দিত‌, কিন্তু তাতে তাদের মন উঠত না। ডাক্তার অবিনাশ সেন সন্দেহ করেন‌, মেয়ে এবং পুত্রবধূ বিষাক্ত খাবার খাইয়ে বুড়োকে মারবার চেষ্টা করছিল। তা যদি হয় তাহলে ছেলে এবং জামাইয়ের মধ্যে ষড় আছে। যা দিনকাল পড়েছে কিছুই অসম্ভব নয়।’

‘মেঘরাজকে মারবার উদ্দেশ্য কি?’

‘মেঘরাজ রাত্রে বেণীমাধবের দোরের সামনে বিছানা পেতে শুতো। দোর ভেজানো থাকত‌, যাতে বেণীমাধব ডাকলেই সে ঘরে ঢুকতে পারে। সুতরাং তাকে বধ না করে ঘরে ঢোকা যায় না। তাকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতে গেলে সে জেগে উঠবে। তাই তাকে আগে মারা দরকার হয়েছিল।’

‘মারণাস্ত্রটা পাওয়া যায়নি?’

‘না। তবে ময়না তদন্ত থেকে জানা গেছে যে‌, অস্ত্রটা খুব ধারালো ছিল। একই অস্ত্র দিয়ে দু’জনকে মেরেছে। অস্ত্রের এক টানে গলা দুফাঁকি হয়ে গেছে।’

‘হত্যার সময়টা জানা গেছে?’

‘স্কুলভাবে রাত্ৰি বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে। ‘

‘হুঁ। সন্দেহভাজন পাঁচজন কারা?’

‘অজয় ও তার স্ত্রী আরতি‌, গায়ত্রী ও তার স্বামী গঙ্গাধর। এবং অজয়ের ছেলে মকরন্দ। মকরন্দকে মেঘরাজ একদিন বেণীমাধবের হুকুমে চড় মেরেছিল। ঝিল্লীকে বাদ দেওয়া যায়‌, সে ছেলেমানুষ‌, তার কোনো মোটিভ নেই।’

‘মকরন্দ ছেলেটা করে কি?’

‘পলিটিক্সের হুজুগ করে। কলেজে নাম লেখানো আছে‌, এই পর্যন্ত। সে-রত্রে আন্দাজ ন’টার সময় বাড়িতে এসেছিল‌, তারপর রাত্রেই কখন বেরিয়ে গেছে। কেউ জানে না। সেই যে পালিয়েছে আর ফিরে আসেনি। তার নামে হুলিয়া জারি করেছি।’

‘বাড়িতে এখন কে কে আছে?’

‘অজয় আরতি গঙ্গাধর গায়ত্রী ঝিল্লী নিখিল রায় সনৎ গাঙ্গুলী আর মেঘরাজের বিধবা মেদিনী। অজয়ের মেয়ে লাব্রণি সে-রাত্রে তার নাচের মাস্টারের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল‌, আর ফিরে আসেনি। নিখিল আর সনৎ রাত্রে কাজে বেরিয়েছিল‌, তারা পরদিন ফিরে এসেছে। যারা বাড়িতে আছে তাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’

‘সকলের আঙুলের ছাপ নিয়েছ নিশ্চয়।’

‘তা নিয়েছি।’

‘খানাতল্লাশ করে কিছু পেলে?’

‘সন্দেহজনক কিছু পাইনি।’

‘বেশ; এবার জবানবন্দীর নথিটা দেখি।’

‘এই যে!’ রাখালবাবু টেবিল থেকে ফাইল তুলে নিয়ে ব্যোমকেশকে দিলেন। এই সময় সদর দরজায় কনস্টেবল এসে জানাল যে‌, সলিসিটার সুধাংশু বাগচী নামে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। রাখালবাবু বললেন—’নিয়ে এসো।’

সুধাংশুবাবু ঘরে প্রবেশ করলেন‌, হাতে পাট করা খবরের কাগজ। রাখালবাবুর পানে চেয়ে বললেন—’আমি বেণীমাধববাবুর সলিসিটার। আজ খবরের কাগজ খুলেই দেখলাম—‘

‘বসুন।’

সুধাংশুবাবু একটি চেয়ারে বসলেন। রাখালবাবু তাঁর সামনে দাঁড়ালেন‌, ব্যোমকেশও এগিয়ে এসে দাঁড়াল।

রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন–’বেণীমাধববাবুর সঙ্গে কবে আপনার শেষ দেখা হয়েছিল?’

সুধাংশুবাবু বললেন-‘পরশু। আমরা অনেকদিন ধরে তাঁর বৈষয়িক কাজকর্ম দেখাশোনা করে আসছি। পরশু তিনি আমাকে ফোন করে জানালেন যে‌, তিনি উইল করতে চান। আমি বিকেলবেলা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উইলে কি কি শর্ত থাকবে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। আমি উইল তৈরি করে আজ তাঁকে দলিল দেখিয়ে সহি-দস্তখত করিয়ে নেব বলে সব ঠিক করে রেখেছিলাম‌, তারপর আজ সকালে কাগজ খুলে এই সংবাদ পেলাম।’

রাখালবাবু চকিতে একবার ব্যোমকেশের পানে চেয়ে বললেন–’উইলে কি কি শর্ত আছে আমাদের বলতে বাধা আছে কি?’

সুধাংশুবাবু বললেন—’অন্য সময় বাধা নিশ্চয় থাকত‌, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় বাধা নেই। বরং আপনাদের সুবিধা হতে পারে।’

তিনি উইলের শর্তগুলি শোনালেন; অপঘাতে মৃত্যু হলে সমস্ত সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পাবে সে কথাও উল্লেখ করলেন।

বেলা এগারটা নাগাদ তিনি উঠলেন‌, বলে গেলেন—’যদি আমার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে চান কিংবা উইল পড়ে দেখতে চান‌, আমার অফিসে খবর দেবেন।’

তিনি চলে যাবার পর রাখালবাবু বললেন—’মোটিভ আরো পাকা হলো। বুড়োকে আর দুদিন বাঁচতে দিলেই এত বড় সম্পত্তিটা বেহাত হয়ে যেত।’

ব্যোমকেশ বলল-’হুঁ। আমি এবার উঠিব। কিন্তু আগে বেণীমাধবের ঘরটা দেখে যেতে চাই?

‘চলুন।’

দোতলার সিঁড়ির মাথায় একজন কনস্টেবল। তেতলায় বেণীমাধবের দরজায় তালা লাগানো‌, উপরন্তু একজন কনস্টেবল টুলে বসে পাহারাদিচ্ছে। মেঘরাজের রক্তাক্ত বিছানা পরীক্ষার জন্য স্থানান্তরিত হয়েছে।

রাখালবাবু পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন‌, দু’জনে ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরের মাঝখানে খাটের ওপর বিছানা নেই‌, আর সব যেমন ছিল তেমনি আছে। ব্যোমকেশ দোরের কাছে দাঁড়িয়ে একবার চারিদিকে চোখ ফেরাল‌, তারপর অস্ফুট স্বরে বলল—’তোমরা অবশ্য সবই দেখেছ‌, তবু—‘

রাখালবাবু ঘাড় নাড়লেন–’অধিকন্তু ন দোষায়।’

‘লোহার সিন্দুকের গায়ে লাগানো ছিল।‘

সিন্দুকের মধ্যে তিনখানা একশো টাকার নোট ছিল‌, পাঁচ টাকা দশ টাকার নোট বা খুচরো টাকা পয়সা একটাও ছিল না। মনে হয় খুনী সিন্দুক খুলে টাকা পয়সা নিয়েছে কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে নম্বরী নোট নেয়নি।’

‘হুঁ। সিন্দুকে আর কী ছিল?’

‘কিছু দলিলপত্র‌, কিছু রসিদ‌, ব্যাঙ্কের খাতা ও চেকবুক। দুটো ব্যাঙ্কে টাকা আছে‌, সাকুল্যে প্রায় চল্লিশ হাজার। তাছাড়া শেয়ার সার্টিফিকেট ও fixed deposit আছে আন্দাজ এগারো লাখ টাকার। মালদার লোক ছিলেন। ছেলে আর মেয়েকে সাড়ে সাত শো টাকা হিসেবে মাস হারা দিতেন। তাঁর নিজের খরচ ছিল সাত শো টাকা‌, মেঘরাজকে মাইনে দিতেন আড়াই শো টাকা। চেকবুকের counter foil থেকে এইসব খবর জানা যায়।’

0 Shares