‘সিন্দুকের ভিতরে কি বাইরে বেণীমাধব ছাড়া অন্য কারুর আঙুলের ছাপ আছে?’
‘কারুর আঙুলের ছাপ নেই, একেবারে লেপা-পোছা।’
‘হ্যাঁ, আততায়ী লোকটি হাঁশিয়ার।’ ব্যোমকেশ সিন্দুক খুলল না, ফ্রিজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল–’ফ্রিজে কারুর আঙুলের ছাপ ছিল?’
‘ছিল। বেণীমাধব, মেঘরাজ এবং মেদিনী-তিনজনের আঙুলের ছাপ ছিল। আর কারুর ছাপ পাওয়া যায়নি।’
হাতল ধরে ব্যোমকেশ ফ্রিজ খুলল, ভিতরে আলো জ্বলে উঠল; ফ্রিজ চালু আছে। ভিতরে নানা জাতের ফলমূল। সারি সারি ডিম, মাছ, মাংস, দুধের বোতল রয়েছে। ব্যোমকেশ আবার দোর বন্ধ করে দিল।
ঘরের পিছন দিকের দেয়ালে একটা লম্বা ধরনের আয়না। টাঙানো ছিল, তার নীচে তাকের ওপর চিরুনী বুরুশ চুলের তেল ও দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম। দাড়ি কামাবার সরঞ্জামের বিশেষত্র এই যে, ক্ষুরটি সেফটি রেজর নয়, সাবেক কালের ভাঁজ-করা লম্বা ক্ষুর। ব্যোমকেশ সন্তৰ্পণে খাপসুদ্ধ ক্ষুর তুলে নিয়ে বলল—’ক্ষুরটা বের করে দেখেছি নাকি?’
রাখালবাবু চক্ষু একটু বিস্ফারিত করলেন, বললেন—’না। বেণীমাধব নিজের হাতে দাড়ি কামাতেন না, মেঘরাজ রোজ সকালে দাড়ি কামিয়ে দিত।’
ব্যোমকেশ সাবধানে ক্ষুরটি খাপ থেকে বের করে দু’ আঙুলে ধরে জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে উলট-পালটে দেখতে লাগল। তারপর বিস্মিত স্বরে বলল—’আশ্চর্য!’
ব্যোমকেশ ক্ষুরটি তাঁর হাতে দিয়ে বলল—’দেখ, কোথাও আঙুলের ছাপ নেই।’
ক্ষুর নিয়ে রাখালবাবু পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন, তারপর ক্ষুর ব্যোমকেশকে ফেরত দিয়ে তার মুখের পানে চাইলেন; দু’জনের চোখ বেশ কিছুক্ষণ পরস্পর আবদ্ধ হয়ে রইল। তারপর ব্যোমকেশ ক্ষুরটি খাপের মধ্যে পুরে নিজের পকেটে রাখল, বলল—’এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
‘কি করবেন?’
‘দাড়ি কামাব।’
তেতলার অন্য ঘর দু’টিতে দর্শনীয় কিছু ছিল না। তবু ব্যোমকেশ ঘর দু’টিতে ঘুরে ফিরে দেখল; তারপর নীচের তলায় নেমে এসে রাখালবাবুকে বলল–’আমি এখন চললাম। বিকেলবেলা আবার আসব। জবানবন্দীর ফাইলটা দাও, বাড়ি গিয়ে পড়ব।’
রাখালবাবু বললেন—’আমাকে একবার থানায় যেতে হবে, চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাই। কি রকম মনে হচ্ছে?’
ব্যোমকেশ মুচকি হেসে বলল–’ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া—’
রাখালবাবু জবানবন্দীর ফাইল ব্যোমকেশকে দিলেন, তাকে নিয়ে পুলিস ভ্যানে চলে গেলেন। দু’জন সাব-ইন্সপেক্টর, এবং কয়েকজন নিম্নতর কর্মচারী বাড়িতে মোতায়েন রইল।
বিকেল তিনটের সময় ব্যোমকেশ ফিরে এল। রাখালবাবু আগেই ফিরেছিলেন, তাঁকে ক্ষুর আর জবানবন্দীর নথি ফেরত দিয়ে ব্যোমকেশ একটা চেয়ারে বসল। রাখালবাবু প্রশ্ন করলেন–কেমন দাড়ি কামালেন?’’
ব্যোমকেশ মাথা নেড়ে বলল–’ভাল নয়।’
‘আর জবানবন্দী?’
‘মেদিনীর জবানবন্দী সবচেয়ে তথ্যপূর্ণ। তাকে আরো কিছু প্রশ্ন করতে চাই।’
‘বেশ তো, তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। সে নিজের ঘরেই আছে।’
কিন্তু মেদিনীকে ডেকে পাঠাবার আগেই দু’জন সাদা পোশাকের পুলিস কর্মচারী মকরন্দকে নিয়ে ঘরে ঢুকাল। মকরন্দর কাপড়-জামা ছিঁড়ে গেছে, গায়ে মুখে ধুলোবালি, চোখ জবাফুলের মত লাল। বেশ বোঝা যায় সে স্বেচ্ছায় বিনা যুদ্ধে পুলিসের হাতে ধরা দেয়নি। একজন সাদা পুলিস বলল–’মকরন্দ চক্রবতীকে ধরেছি। স্যার।’
রাখালবাবু মকরন্দর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন-ইনিই মকরন্দ চক্রবর্তী! কোথায় ধরলে?’
‘ঘোড়দৌড়ের মাঠে। রেস খেলছিল স্যার। পকেটে অনেক টাকা ছিল। এই যে।’
এক তাড়া পাঁচ টাকা ও দশ টাকার নোট। রাখালবাবু গুনে দেখলেন, পৌঁনে দু’ শো টাকা। তিনি মকরুন্দকে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করলেন–তোমার নাম মকরন্দ চক্রবর্তী?’
মকরুন্দ রক্তরাঙা চোখে চেয়ে রইল, উত্তর দিল না। রাখালবাবু আবার প্রশ্ন করলেন—’তুমি পৌঁনে দু’ শো টাকা কোথায় পেলে?’
উদ্ধত উত্তর হলো–’বলব না।’
‘যে-রাত্রে তোমার ঠাকুরদা খুন হন সে-রাত্রে ন’টার সময় তুমি বাড়ি এসেছিলে, তারপর শেষরাত্রে চুপিচুপি দোর খুলে বেরিয়ে গিয়েছিলে–’
‘মিছে কথা। মেদিনী মিছে কথা বলেছে।’
‘মেদিনী বলেছে জানলে কি করে?’
মকরন্দ, অধর দংশন করল, উত্তর দিল না। রাখালবাবু আবার প্রশ্ন করলেন–’কত রাত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে?’
‘বলব না।’
‘তারপর আর বাড়ি ফিরে আসনি কেন?’
রাখালবাবু তার খুব কাছে এসে বললেন—’একদিন বেণীমাধববাবুর হুকুমে মেঘরাজ তোমার কান ধরে গালে চড় মেরেছিল, গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল।’
‘মিছে কথা।’
‘বাড়িসুদ্ধ লোক মিছে কথা বলছে?
‘হ্যাঁ।‘
রাখালবাবু ফিরে এসে ব্যোমকেশের পাশে বসলেন, গলা খাটো করে বললেন–এটাকে নিয়ে কী করা যায় বলুন দেখি?’
ব্যোমকেশও নীচু গলায় বলল—’যুগধর্মের নমুনা। ওকে বাড়িতেই আটক রাখ।’
‘তাই করি।’ রাখালবাবু উঠে গিয়ে মকরন্দকে কড়া সুড়ে বললেন—’যাও, দোতলায় নিজের ঘরে থাকো গিয়ে। বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা কোরো না, চেষ্টা করলে হাজতে গিয়ে লাপসি খেতে হবে। যাও।’
সাদা পোশাকের পুলিস দু’জন মকরন্দকে দোতলায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। রাখালবাবু বললেন–’মেদিনীকে ডেকে পাঠাই?’
ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল-না, চল আমরাই তার ঘরে যাই। এখানে অনেক বাধাবিঘ্ন।’
মেদিনীর দোরে টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মেদিনী মেঝেয় মাদুর পেতে শুয়ে আছে। ব্যোমকেশ ও রাখালবাবুকে দেখে সে উঠে বসল। তার পরনে ধূসর রঙের একটা শাড়ি, কপালে সিঁদুর নেই, হাতে গলায় কানে গয়না নেই। মুখের ভাব একটু ফুলো ফুলো; শোকের চিহ্ন এখনো মুখ থেকে মুছে যায়নি, কিন্তু শোকের অধীরতা দূর হয়েছে। সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্নভরা চোখে দু’জনের পানে চাইল।