বেণীসংহার

রাখালবাবু সদয় কণ্ঠে বললেন—’মেদিনী‌, ইনি আমার বন্ধু। আমি তোমাকে যেসব প্রশ্ন করেছি। তার ওপর ইনি আরো দু-চারটে সওয়াল করতে চান।’

মেদিনী ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় বলল—’জি।’

ব্যোমকেশ একদৃষ্টে মেদিনীর মুখের পানে চেয়ে ছিল‌, আরো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল–’কতদিন আগে মেঘরাজের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল?’

মেদিনী অস্ফুট কণ্ঠে বলল–’পাঁচ বছর আগে।’

‘তুমিই তার প্রথম স্ত্রী?’

‘জি‌, না। আগে একজন ছিল‌, সে মারা গেছে।’

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে চাইল। ঘরে ফার্নিচারের মধ্যে একটা তক্তপোশ‌, একটা কাঠের আলমারি এবং একটা খাড়া আলনা। তক্তপোশের তলায় গোটা দুই বড় তোরঙ্গ দেখা যাচ্ছে। বাইরের দিকের জানালার পটার ওপর একটা কাঠের চ্যাপটা বাক্স। পশ্চিমা মেয়েরা প্রসাধনের জন্যে এই ধরনের বাক্স ব্যবহার করে; বাক্সের মধ্যে সিঁদুর কোটো চিরুনী তেল কাজল প্রভৃতি থাকে‌, ডালা খুললে ডালার গায়ে আয়না বেরিয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে নিতান্ত মামুলি পারিবেশ।

ব্যোমকেশ এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল—’বাড়ির সকলকেই তুমি চেন। কে কেমন মানুষ বলতে পার?

মেদিনী একটু চুপ করে থেকে হাতের নখ খুঁটিতে খুঁটিতে বলল—’বুঢ়া বাবা বড় ভাল আদমি ছিলেন‌, দিলদার লোক ছিলেন। তাঁর ছেলে আর দোমাদও ভাল লোক। মেয়ে আর পুতন্থ আমাকে পছন্দ করেন না। ঝিল্লী দিদি আর লাব্রণি দিদি ভারি ভাল মেয়ে।’

‘আর মকরন্দ?

মেদিনী চকিতে চোখ তুলেই আবার নীচু করল—’উনি আমাকে দেখতে পারেন না। ভারি কড়া জবান।’

‘মেঘরাজ তাকে চড় মেরেছিল তুমি জানো?’

‘জি হ্যাঁ, আমি তখন পাশের ঘরে ছিলুম।’

‘নিখিল আর সনৎ?’

‘নিখিলবাবু মজাদার লোক‌, খুব ঠাট্টা তামাসা করেন। আর সনৎবাবু গভীর মেজাজের মানুষ। কিন্তু দু’জনেই খুব ভদ্র।’

‘আচ্ছা‌, ওকথা থাক। মেঘরাজ সৈন্যদলের সিপাহী ছিল‌, তার সিপাহী-জীবন সংক্রান্ত কাগজপত্র নিশ্চয় তোমার কাছে আছে?’

‘জি আছে‌, তার বাক্সের মধ্যে আছে।’

‘আমি একবার কাগজপত্রগুলো দেখতে চাই।’

‘এই যে বার করে দিচ্ছি।’

সে গিয়ে তক্তপোশের তলা থেকে একটা ট্রাঙ্ক টেনে বার করল‌, আচল থেকে চাবি নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ট্রাঙ্ক খুলতে লাগল। ব্যোমকেশ ইতিমধ্যে ঘরের এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানলার ওপর প্রসাধনের বাক্সটা রাখা আছে। ব্যোমকেশ একটু ইতস্তত করে বাক্সের ডালা তুলল। বাক্সের মধ্যে মেয়েলি প্রসাধনের দ্রব্য ও টুকিটুকি; আয়নার এক কোণে মেদিনীর একটি ছবি আটা রয়েছে। পোস্টকার্ড আধখানা করলে যত বড় হয় তত বড় ছবি; মেদিনী খাটের ধারে বসে রয়েছে। নিতান্তাই ঘরোয়া ছবি‌, মেদিনীর মুখের প্রাণখোলা হাসিটি ব্যোমকেশের গায়ে কাঁটার মত বিধল। মেদিনীর বর্তমান চেহারা দেখে ভাবা যায় না। সে এমনভাবে হাসতে পারে। ব্যোমকেশ নিঃশব্দে বাক্স বন্ধ করল।

মেদিনী ট্রাঙ্ক থেকে কাগজপত্র নিয়ে যখন ফিরে এল তখন ব্যোমকেশ রাখালবাবুর কাছে ফিরে এসে নিম্নস্বরে কথা বলছে‌, মেদিনীর হাত থেকে কাগজপত্র নিয়ে সে মন দিয়ে পড়ল। রাখালবাবুও সঙ্গে সঙ্গে পড়লেন। তারপর কাগজ মেদিনীকে ফেরত দিয়ে ব্যোমকেশ মেদিনীকে বলল–’এগুলো যত্ন করে রেখে দাও‌, হয়তো পরে দরকার হবে। চল রাখাল।’

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাখালবাবু ব্যোমকেশের দিকে চোখ বেঁকিয়ে তাকালেন—’কি মনে হলো?’

ব্যোমকেশ বলল—’খুব ভাল। এবার বাড়ির বাকি লোকগুলিকেও একে একে দেখতে চাই। সবাই বাড়িতে আছে তো?’

‘সবাই আছে‌, কেবল অজয়ের মেয়ে লাব্রণি ছাড়া। যে-রাত্রে খুন হয়‌, লাব্রণি সেদিন সন্ধ্যের সময় তার নাচের মাস্টারের সঙ্গে পালিয়েছে‌, এখনো তার সন্ধান পাইনি। অন্য যারা আছে তাদের মধ্যে আগে কাকে দেখতে চান?

‘আমার কোনো পক্ষপাত নেই। নীচের তলা থেকেই আরম্ভ করা যাক।’

নিখিলের দোরে রাখালবাবু টোকা দিলেন‌, নিখিল এসে দোর খুলে দাঁড়াল। তার গালে সাবানের ফেনা‌, হাতে সেফটি রেজর; সে ফেনায়িত হাসি হাসল–’আসুন দারোগাবাবু।’

রাখালবাবু ব্যোমকেশকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন‌, প্রশ্ন করলেন-বিকেলবেলা দাড়ি কামাচ্ছেন?’

নিখিল বলল–’আমি নিশাচর। কিনা তাই বিকেলবেলা দাড়ি কামাই। যারা দিনের বেলা কাজ করে তারা সকালবেলা দাড়ি কামায়।’ তারপর সে ব্যগ্রস্বরে বলল–’দারোগাবাবু্‌, এক ঘন্টার জন্য আমাকে ছেড়ে দিন‌, একবারটি অফিস ঘুরে আসি। মাইরি বলছি পালাব না। বিশ্বাস না হয় দু’জন পেয়াদা আমার সঙ্গে দিন।’

রাখালবাবু হেসে বললেন–’অফিসে যাবার জন্যে এত ব্যস্ত কেন? বেশ তো আছেন।’

নিখিল বলল–’না দারোগাবাবু্‌, বেশ নেই। কাজের নেশা আমাকে অফিসের দিকে টানছে‌, রাত্তিরে ঘুমোতে পারি না। তা ছাড়া—’

‘তা ছাড়া আবার কি?’

নিখিল একটু সলজ্জভাবে বলল–’অফিসে অনেকগুলো আইবুড়ো মেয়ে কাজ করে‌, তাদের মধ্যে একটাকে আমি খুঁজছি‌, পেলেই তাকে বিয়ে করব।’

‘ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যময় ঠেকছে।’

‘ঠেকবেই তো। ঘোর রহস্যময় ব্যাপার।’

‘ঘোর রহস্যময় যদি হয় তাহলে এঁর শরণাপন্ন হোন। ইনিই হলেন শ্ৰীব্যোমকেশ বক্সী।’

নিখিলের গালে সাবানের ফেনা শুকিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছিল‌, সে প্রকাণ্ড হ্যাঁ করে ব্যোমকেশের পানে তাকাল–’অ্যাঁ‌, আপনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! এতক্ষণ লক্ষ্যই করিনি।’ সেফটি রেজরাসুদ্ধ হাত জোড় করে বলল—’আমার রহস্যটা আপনাকে ভেদ করতেই হবে ব্যোমকেশবাবু। নইলে আমার প্রাণের আশা নেই।’

0 Shares