বেণীসংহার

‘সব কথা খুলে বলুন।’

নিখিল তড়বড় করে এক নিশ্বাসে তার রহস্য শোনাল। শুনে ব্যোমকেশ বলল—’চিঠিগুলো দেখি।‘

নিখিল বিছানার কাছে গিয়ে বালিশের তলা থেকে কয়েকখানা খাম এনে ব্যোমকেশকে দিল। ব্যোমকেশ খামগুলি খুলে একে একে চিঠি বার করে পড়ল‌, তারপর আবার খামের মধ্যে পুরে নিজের পকেটে রাখল–’এগুলো আমি রাখলাম। দেখি যদি সন্ধান পাই। আপনি আপাতত এই বাড়িতেই থাকুন‌, আমি আপনার অফিসে খোঁজখবর নেব। —ভাল কথা‌, আপনার বিষতি আছে?’

বর্ষাতি-ওয়াটারপ্রুফ? আছে একটা। কেন বলুন তো?’

‘দেখি একবার।’

নিখিল সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে একটা পুরনো খাকি রঙের বিষতি নিয়ে এল। ব্যোমকেশ সেটা রাখালবাবুর হাতে দিয়ে বলল–’এটাও আমরা নিয়ে চললাম। এটা আপনি শেষবার কবে ব্যবহার করেছেন?’

নিখিল কিছুই বুঝতে পারেনি এমনিভাবে মাথা চুলকে বলল–’গত বিষাকালে‌, মানে পাঁচ ছয় মাস আগে। আপনি যে ভেলকি লাগিয়ে দিলেন‌, ওয়াটারপ্রফ থেকে আমার-মানে মেয়েটার ঠিকানা বার করবেন নাকি?’

ব্যোমকেশ কেবল মুখ টিপে হাসল‌, বলল—’আপনি দেখছি সেফটি রেজর দিয়ে দাড়ি কামান।‘

‘তবে কি দিয়ে দাড়ি কামাব?’

‘ঠিক কথা। আপনি যখন দাড়ি কামাতে আরম্ভ করেছেন তখন সাবেক ক্ষুরের রেওয়াজ উঠে গেছে!–আচ্ছা।’

ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পানে বক্র কটাক্ষপাত করল। রাখালবাবু অপ্রতিভভাবে বললেন–’খেয়াল হয়নি। হওয়া উচিত ছিল। যে-লোক ছুরি কিংবা ক্ষুর দিয়ে গলা কাটতে যাচ্ছে‌, সে জানে গলা কাটলে চারদিকে রক্ত উথলে পড়বে‌, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটিবে। তার নিজের গায়েও রক্ত লাগবে। তাই সে বিষতি কিংবা ওই রকম একটা কিছু গায়ে দিয়ে খুন করতে যাবে‌, যাতে সহজে রক্ত ধুয়ে ফেলা যায়।’

এই সময় সদর দোরের কনস্টেবল এসে একখানা পোস্টকার্ড রাখালবাবুর হাতে দিয়ে বলল–’পিওন দিয়ে গেল।’

রাখালবাবু নিদ্বিধায় পোস্টকার্ড পড়লেন। অজয় চক্রবর্তীর নামে চিঠি‌, তারিখ আজ সকালের‌, ঠিকনা টালিগঞ্জ। চিঠিতে কয়েক ছত্র লেখা আছে–

শ্ৰীচরণেষু মা‌,

কাল রাত্তিরে আমাদের বিয়ে হয়েছে। তোমরা রাগ কোরো না। আমার শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভালো লোক। পরশু রাত্রে আমি শাশুড়ির কাছে শুয়েছিলাম। দাদু অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিলেন তাই আমরা লুকিয়ে বিয়ে করেছি।

প্রণতা

লাবণি

চিঠিতে চোখ বুলিয়ে রাখালবাবু ব্যোমকেশের হাতে চিঠি দিলেন, ব্যোমকেশ সেটা পড়ে ফেরত দিল। বলল–’বোধহয় ঠাকুরদার মৃত্যু-সংবাদ পায়নি। যাক‌, বিয়ে করেছে ভালই করেছে‌, নইলে–’

চিঠি পকেটে রেখে রাখালবাবু একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে ডাকলেন—’এই বিষতিটা রাখো। আরো বোধহয় জুটবে; সবগুলো জড় হলে পরীক্ষার জন্যে পাঠাতে হবে। এটাতে টিকিট সেঁটে রাখ-নিখিল হালদার।’

তারপর তিনি সন্নতের দোরে টোকা দিলেন। সনৎ এসে দোর খুলল; তার হাতে একটা ইংরেজি রহস্য উপন্যাস পাতা ওলটানো অবস্থায় রয়েছে। রাখালবাবুকে দেখে বলল–’ইন্সপেক্টরবাবু্‌, আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে‌, এক টিন আনিয়ে দেবেন? গোল্ড ফ্লোক।’

‘নিশ্চয়। টাকা দিন আনিয়ে দিচ্ছি।’

সনৎ একটা দশ টাকার নোট পকেট থেকে বার করে দিল। রাখালবাবু টাকা সাব-ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়ে বললেন—’এক টিন গোল্ড ফ্রেক সিগারেট সামনের দোকান থেকে আনিয়ে দাও।’

তিনি ব্যোমকেশকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। সনৎ বলল–’আর কতদিন ঘরে বন্ধ করে। রাখবেন? কাজকর্ম আটকে রয়েছে। তা ছাড়া মামা মারা যাবার পর তাঁর উত্তরাধিকারী এখানে আর থাকতে দেবে না‌, মাথা গোঁজবার একটা জায়গা খুঁজতে হবে তো।’

‘থাকতে দেবে না কি করে জানলেন?’

‘আজ দুপুরবেলা গায়ত্রীর স্বামী গঙ্গাধর এসেছিল‌, বলল-এবার পাতাতাড়ি গোটাতে হবে।’

‘তাই নাকি!–বেশি দিন আপনাদের কষ্ট দেব না‌, দু’এক দিনের মধ্যে ছাড়া পাবেন। ইনি ব্যোমকেশ বক্সী‌, প্রখ্যাত সত্যান্বেষী।’

সনৎ নির্লিপ্ত চোখে ব্যোমকেশের পানে চাইল‌, নীরস স্বরে বলল–’নাম শুনেছি‌, বই পড়িনি। বাংলা রহস্য কাহিনী আমি পড়ি না। —বসুন।’

ব্যোমকেশের চোখ ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল‌, সে অলসভাবে বলল—’আপনার বিষতি আছে?’

সনৎ ভ্রূ তুলে একটু বিস্ময় প্রকাশ করল—’আছে। এটা বিষাকাল নয়। তাই তুলে রেখেছি। দেখতে চান?’

‘হ্যাঁ।‘

সনৎ আলমারি খুলে একটা প্ল্যাস্টিকের মোড়ক বার করল। মোড়কের মধ্যে একটি শৌখিন স্বচ্ছ বিষতি পাট করা রয়েছে। রাখালবাবু সেটি নিয়ে মোড়ক থেকে বার করলেন‌, তারপর লম্বা করে ঝুলিয়ে দেখলেন। দামী বিষতি‌, প্রায় নতুন। তিনি সেটিকে পাট করে আবার মোড়কের মধ্যে রেখে বললেন—’এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি‌, দু’ দিন পরে ফেরত পাবেন। রসিদ দিচ্ছি।’

সনৎ অপ্রসন্ন উদাস কণ্ঠে বলল–’রসিদ কি হবে! আপনাদেরই রাজত্ব‌, যা ইচ্ছে করুন।’

ব্যোমকেশ হঠাৎ প্রশ্ন করল—’আপনার জবানবন্দীতে দেখলাম যে-রাত্ৰে বেণীমাধববাবু খুন হন সে-রত্রে আপনি বর্ধমানে গিয়েছিলেন। কোন ট্রেনে গিয়েছিলেন?’

সনৎ বলল–’রাত্রি সাড়ে দশটার ট্রেনে।’

‘পরদিন ভোরের ট্রেনে না গিয়ে রাত্রির ট্রেনে গেলেন কেন?’

‘ভোরের ট্রেনে গেলে ঠিক সময়ে পৌছুঁতে পারতাম না। সকালবেলা মজলিশ ছিল।’

‘বর্ধমানে আপনার কোনো আস্তানা আছে?’

‘না‌, স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে রাত কাটিয়েছি।’

‘চায়ের স্টলে গিয়ে চা খেয়েছিলেন নিশ্চয়?’

‘চা আমি খাই না।’

‘তাহলে আপনি যে সাড়ে দশটার গাড়িতে বর্ধমান গিয়েছিলেন তার কোনো সাক্ষী-সার্বুদ নেই?’

0 Shares