বেণীসংহার

সনতের ভুরু আবার উঁচু হলো—’সাক্ষী-সাবুদের কী দরকার? আপনাদের কি সন্দেহ আমি মামাকে খুন করেছি?’

ব্যোমকেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—’তা নয়। কিন্তু সকলের সম্বন্ধেই আমাদের নিঃসংশয় হওয়া দরকার।’

সনৎ শুকনো গলায় বলল–’মামাকে খুন করে যাদের লাভ আছে তাদের অ্যালিবাই খুঁজুন গিয়ে। তাতে কাজ হবে।’

‘তা বটে। চল রাখাল‌, এবার দোতলায় যাওয়া যাক।’

প্রথমে ড্রয়িংরুমে গিয়ে রাখালবাবু সনতের বিষতি সাব-ইন্সপেক্টরকে সমৰ্পণ করে বললেন-টিকিট মারো-সনৎ গাঙ্গুলি।’ তারপর ব্যোমকেশকে নিয়ে দোতলায় উঠলেন।

অজয় সামনের ঘরে বসে সায়হ্নিক চা জলখাবার খাচ্ছিল‌, সশঙ্ক মুখে উঠে দাঁড়াল। তার মুক্তকচ্ছ অশৌচের বেশ‌, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। রাখালবাবু গম্ভীর মুখে আম-আপনার একখান চিঠি এসেছে।’ তিনি পোস্টকার্ড পকেট থেকে নিয়ে অজয়কে দিলেন।

ব্যোমকেশ নিবিষ্ট চোখে অজয়ের পানে চেয়ে ছিল; সে দেখল চিঠি পড়তে পড়তে অজয়ের মুখের ওপর দিয়ে দ্রুত পরম্পরায় বিচিত্র ভাবের অভিব্যক্তি খেলে গেল : আশঙ্কা-বিস্ময়-স্বস্তি-উৎফুল্লতা। তার মধ্যে স্বস্তির আরামই বেশি। অজয়ের মত প্রকৃতির লোকের পক্ষে এটাই বোধহয় স্বাভাবিক; বিনা খরচে বিনা ঝঞ্ঝাটে যদি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় তাহলে আনন্দ হবারই কথা।

কিন্তু সে যখন মুখ তুলল। তখন তার মুখে একটি বিষণ্ণ করুণ ভাব‌, তাতে রঙ্গমঞ্চের আভাস পাওয়া যায়। সে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল–’মেয়ে! দারোগাবাবু্‌, আমার একমাত্র মেয়ে পালিয়ে গিয়ে একজনকে বিয়ে করেছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড় নিষ্ঠুর‌, বড় স্বার্থপর‌, তারা বাপ-মায়ের কথা ভাবে না। যাক‌, যা করেছে ভালই করেছে। তবু যদি জাতের মধ্যে বিয়ে করত। যাক‌, ভাল হলেই ভাল।’ সে আবার নাটকীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

রাখালবাবু বোধকরি অভিনয়ের পালা শেষ করার জন্যেই বললেন-ইনি ব্যোমকেশ বক্সী। বোধহয় নাম শুনেছেন।’

অজয় তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল; তার ভাবভঙ্গীতে ভয় কিংবা বিস্ময় কিংবা আনন্দ কোনটা প্রকাশিত হলো ঠিক বোঝা গেল না। তারপর সে গদগদ স্বরে বলে উঠল—’নাম শুনিনি! বলেন কি আপনি‌, নাম শুনিনি। আসুন আসুন‌, কি সৌভাগ্য আমার। ব্যোমকেশবাবু এসেছেন‌, এবার বাবার মৃত্যু রহস্যের একটা কিনারা হবে।’ সে অন্দরের দরজার দিকে ফিরে গলা চড়িয়ে বলল–’ওগো শুনছ‌, শীগগির দু’ পেয়ালা চা নিয়ে এসো। —বসুন বসুন‌, আমি নিজেই দেখছি।’ সে দ্রুত অন্দরের দিকে অন্তর্হিত হলো।

সমাদ্দারের আতিশয্য দেখে ব্যোমকেশ রাখালবাবুর পানে মুখ টিপে হাসল; দু’জনে পাশাপাশি চেয়ারে উপবিষ্ট হলেন।

কিছুক্ষণ পরে অজয় ফিরে এল‌, তার পিছনে মাথায় আধ-ঘোমটা দিয়ে আরতি; আরতির হাতে থালার ওপর দু’ পেয়ালা চা এবং বিস্কুট। তার মুখ ভয়ে শীর্ণ হয়ে গেছে‌, সে থালাটি ব্যোমকেশের সামনে রেখেই ফিরে যাচ্ছিল‌, অজয় বলল,–’ওকি‌, চলে যােচ্ছ কেন? ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে কথা কও।’

আরতি থমকে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশের দিকে ফিরল‌, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। ব্যোমকেশ তার অবস্থা লক্ষ্য করে সদয় কণ্ঠে বলল–’না না‌, উনি কাজকর্ম করুন গিয়ে‌, ওঁকে আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।’

আরতি চলে গেল। অজয় আমতা-আমতা করে বলল—’আমার স্ত্রী বড় লাজুক‌, কিন্তু আমরা দু’জনেই আপনার ভক্ত—’ অজয় আরো অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল‌, ব্যোমকেশ বাধা দিয়ে বলল–’আপনার ছেলে মকরুন্দ বাড়িতেই আছে তো?’

অজয় চকিত হয়ে বলল–’আছে বৈকি। তাকে ডাকব?’

ব্যোমকেশ বলল–’ডাকবার বোধহয় দরকার হবে না। সে কলেজে পড়ে‌, বিষাকালে নিশ্চয় তার বিষতি দরকার হয়। তার বিষতিটা একবার দেখতে চাই।’

অজয় একটু চিন্তা করে বলল–’বছর দেড়েক আগে তাকে একটা ওয়াটারপ্রুফ কিনে দিয়েছিলাম। আছে নিশ্চয়‌, আমি দেখছি।’

অজয় অন্দরের দিকে চলে গেল। ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু চায়ের পেয়ালা তুলে নিলেন। মিনিট পাঁচেক পরে অজয় ফিরে এসে বিমর্ষ মুখে বলল—’ওয়াটারপ্রুফটা খুঁজে পেলাম না। মকরন্দকে জিজ্ঞেস করলাম‌, সে বলল—জানি না।’

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালা রেখে মুখ মুছতে মুছতে বলল–’আপনার নিজের ওয়াটারগুফ আছে?’

‘আছে। এনে দেব?’

‘আপনার স্ত্রীর এবং মেয়ের ওয়াটারপ্রফ?’

‘মেয়েদের জন্যে একটাই মেয়েলি ওয়াটারপ্রুফ আছে।’

‘দয়া করে ও দুটো এনে দিন‌, আমরা নিয়ে যাব। দু’চার দিনের মধ্যেই ফেরত পাবেন।’

‘নিয়ে যাবেন‌, বেশ তো‌, তা এনে দিচ্ছি।’

অজয় অন্দরে গিয়ে দুহাতে দু’টি ওয়াটারগুফ ঝুলিয়ে নিয়ে ফিরে এল। রাখালবাবু সে দু’টি পাট করে বগলে নিলেন‌, বললেন—’আচ্ছা‌, আজ উঠি। চায়ের জন্যে ধন্যবাদ।’

অজয় কচুমাচু হয়ে ব্যোমকেশকে বলল–’চললেন? একটা অনুরোধ ছিল সাহস করে বলতে পারছি না

‘কি অনুরোধ?’

‘আপনার একটা ফটো তুলব। আমার ক্যামেরা আছে‌, যদি অনুমতি করেন একটা তুলে নিই। আপনার ছবি এনলার্জ করে ঘরে টাঙিয়ে রাখব।’

ব্যোমকেশ হেসে উঠল—’ফটো তুলবেন। তা-আপত্তি কি। আমার ছবি এনলার্জ করে ঘরে টাঙিয়ে রাখার আগ্রহ আজ পর্যন্ত কারো দেখা যায়নি।’

অজয় দ্রুত গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে এল। সাধারণ বক্স-ক্যামেরা। সে বললে–’এখনো যথেষ্ট আলো আছে। আপনি জানালার কাছে দাঁড়ান‌, আমি ছবি তুলে নিচ্ছি।’

ব্যোমকেশ জানলার পাশে পড়ন্ত আলোয় দাঁড়াল। ক্যামেরায় ক্লিক করে শব্দ হলো।

‘ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! অশেষ ধন্যবাদ!’ শুনতে শুনতে ব্যোমকেশ রাখালবাবুকে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।

0 Shares